
সনাতন সম্প্রদায়ের দীপাবলী উৎসব উপলক্ষ্যে ভাটিকান আন্তঃধর্মীয় ডিকাস্টেরী থেকে প্রেরিত শুভেচ্ছা বাণী
মূলসুর: খ্রীষ্টান ও হিন্দু: সত্য, ন্যায্যতা, প্রেমময়তা ও স্বাধীনতায় শান্তি স্থাপন
সুপ্রিয় সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধুগণ,
এই বছর ১২ নভেম্বর রবিবার বিশ্বজুড়ে আপনারা শুভ ‘দীপাবলি’ পার্বোৎসব পালন করছেন। এই উৎসব উপলক্ষ্যে ভাটিকানের আন্তঃধর্মীয় সংলাপ দপ্তর আপনাদের সবাইকে জানায় আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন । সেই সর্বমহান দিব্য জ্যোতি পরমেশ্বর আপনাদের হৃদয়-মন আলোকিত করুন; আপনাদের পরিবার ও প্রতিবেশী সবাইকে আশীষধন্য করুন এবং সুখানন্দে আপনাদের জীবন ভরে তুলুন।
এই বছরে আমরা সাধু পোপ ত্রয়োবিংশ যোহনের সার্বজনীন পত্র ‘পৃথিবীতে শান্তি’ (চধপবস রহ ঞবৎৎরং)-এর ষোড়শ বার্ষিকী উদযাপন করছি। পত্রটির পটভূমি হিসাবে বলা যায় যে, ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে গোটা বিশ্ব যখন ছিল গভীর যন্ত্রনায় কাতর এবং পরমানু যুদ্ধের খুবই নিকটবর্তী, ঠিক তখনই সেই দলিলটি প্রকাশ করেছিল সময়পোযুগী, প্রবল আবেগে অভিভূত ও অতি প্রয়োজন মোতাবেক এক আবেদন। আবেদনটি ছিল পৃথিবীর সকল নেতৃবৃন্দ ও জনগণের প্রতিঃ তারা যেন শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে একত্রে কাজ করে; এবং তাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিল যে, সংলাপ ও পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তারা যেন পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের মানসিকতায় সমস্যাগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করে। পোপ ত্রয়োবিংশ যোহন, যিনি এখন একজন সাধু হিসাবে স্বীকৃত ও সন্মানিত, একজন প্রবক্তার মতোই উল্লেখ করেছিলেন যে, “শান্তি যদি একটি নিয়মের ছাঁচে না থাকে, তাহলে তা শুধুই একটি মুখের বুলি হয়েই থাকে; আর এই নিয়ম সত্যে সংস্থাপিত, ন্যায্যতার উপর গঠিত, সেবা দ্বারা পরিপুষ্ট ও সঞ্জীবিত এবং স্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষকতার অধীনে ঈপ্সিত ফল এনে দেয়।” (অনুচ্ছেদ ১৬৭)। যে মহতি এক দর্শন এই সার্বজনীন পত্রটি শান্তি স্থাপনের জন্য প্রস্তাব রেখেছিল, তাতে প্রবুদ্ধ হয়ে, এই দীপাবলী উপলক্ষ্যে সত্য, ন্যায্যতা, প্রেমময়তা ও স্বাধীনতায় শান্তি স্থাপন বিষয়টির উপর কিছু অনুধ্যান আমরা আপনাদের সাথে সহভাগিতা করতে চাই ।
‘পৃথিবীতে শান্তি’ (চধপবস রহ ঞবৎৎরং)-এর শিক্ষাবাণী বিগত ছয় শতাব্দী ধরে বিভিন্ন মাত্রায়, বিশ্বব্যপী জনগণের মধ্যে যে এক তীব্রতর চেতনা জাগিয়ে তুলেছে, তা হল, ব্যক্তি মানুষজনের অতীন্দ্রিয় মর্যাদা রক্ষা করা, তাদের বৈধ অধিকারসমূহ রক্ষা করা এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার মনোভাব নিয়ে সবার অংশ গ্রহণে সাধারণ মঙ্গলের জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা। পত্রটি প্রকাশের ফলে জেগে উঠেছিল বিভিন্ন আন্দোলন; এগুলো সংলাপ ও পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে মানবঅধিকারসমূহ রক্ষা ও প্রতিরক্ষা এবং শান্তি স্থাপন করার কাজে ছিল নিবেদিত। তৎসত্বেও পত্রটির শান্তির এই প্রাবক্তিক বাণীর পূর্ণ বাস্তবায়ন এক সুদূরপ্রসারী স্বপ্নই রয়ে গেল, যে-স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে একমাত্র প্রত্যেক ধর্মীয় ঐতিহ্যের নারী ও পুরুষ এবং সমাজের সকল শাখার মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতাসম্পন্ন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। আর শান্তি স্থাপনের অধিকতর উন্নতির লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টাসমূহকে চলমান রাখতেই হবে।
শান্তি পোষণ করার লক্ষ্যে এবং সার্বজনীন সাধারণ কল্যাণ সাধনার এই উদ্যোগসমূহের ফলে যেন নৈরাশ্যবাদ, নিরুৎসাহ এবং পরিহার এমন-সব মনোভাব জন্ম না দেয়।
তবে এমন-সব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী বা মনোবৃত্তি তৎপর হতে পারে মানব মর্যাদার জন্য ঘৃন্য উদাহারণ, নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারসমূহ, ধর্মীয় অধিকারসমূহ অস্বীকার বা সংকোচন; অসহিষ্ণুতা ও হিংসা, অন্যায্যতা ও বৈষম্য, উৎপীড়ন, আক্রমন বিশেষভাবে তাদের প্রতি যারা গোষ্ঠিগত, কৃষ্টিগতভাবে ভিন্ন; অর্থনৈতিকভাবে, ভাষাগতভাবে, ধর্মগতভাবে ভিন্ন, অথবা তাদেরই বিরুদ্ধে যারা সমাজের অধিকতর হতদরিদ্র।
যেমনটি ছিল ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে, আজও পৃথিবীতে নৈরাশ্য, হতাশা, নিরাশা বিদ্যমান; তথাপি সাধু পোপ ত্রয়োবিংশ যোহন, একজন গভীর আশাবাদী মানুষ হিসেবে, এমনভাবে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে, শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, যদি তা সত্য, ন্যায্যতা, ভালবাসা ও স্বাধীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। স্মৃতির পাতায় নিয়ে আসি সাধু পোপ দ্বিতীয় জন পলকে, যিনি বলেছিলেন যে, সত্য, ন্যায্যতা, ভালবাসা ও স্বাধীনতা, এগুলো হলো, “শান্তি স্থাপনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত” এবং মৌলিক “ভিত্তি-স্তম্ভ” (পভ. গবংংধমব ভড়ৎ ঃযব পবষবনৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ২০০৩ ডড়ৎষফ উধু ড়ভ চবধপব – চধপবস রহ ঞবৎৎরং: অ চবৎসধহবহঃ ঈড়সসরঃসবহঃ ঘড়ং. ৩-৪)। বিশ্বাসী হিসাবে এক অটল ও সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শান্তির জন্য আমাদের উচ্চাভিলাষ প্রকাশ করা প্রয়োজন যা সেই স্তম্ভগুলোর প্রতি এক অকম্পিত বিশ্বস্ততার উপর সংস্থাপিত।
আমাদের শক্তি-সামর্থে প্রত্যেটি মাধ্যম বা উপায় ব্যবহার দ্বারা একটি শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টাসমূহে আমাদের প্রয়োজন শান্তির এই স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী করা। এই কারণেই, প্রবীণ ও পিতামাতাদের উদাহারণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে পরিবার, সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও মিডিয়া এমন ভূমিকা পালন করবে, যা শান্তির জন্য সবার অন্তরে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলবে এবং এমন মূল্যবোধ শিক্ষা দিবে যা প্রতিটি যুগের পুরুষ ও নারীর মধ্যেই শান্তি গড়ে তোলে।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসী ভাইবোনদের সাথে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সামাজিক বন্ধুত্ব স্থাপন করার বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়; আর প্রকৃতপক্ষেই এটি হয়ে উঠেছে “পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের অবদান রাখার প্রয়োজনীয় শর্ত” (চড়ঢ়ব ঋৎধহপরং, অফফৎবংং ঃড় ঃযব উবষবমধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ‘ঊসড়ঁহধ ঋৎধঃবৎহরঃব’ অষঁসহর’ অংংড়পরধঃরড়হ, ২৩ ঔঁহব ২০১৮)। অতএব, ধর্মসমূহ এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা হবে, তাদের অনুসারীদের এমনই মানুষ হওয়ার উৎসাহ দেওয়া যাদের জীবনটাই হবে সত্য, ন্যয্যতা, ভালবাসা ও স্বাধীনতা দিয়ে গঠিত, পরিচালিত ।
আপন আপন ধর্মের বিশ্বাসী ও ধর্মীয় নেতা হিসাবে, উন্মুক্ত প্রত্যয়সমূহ এবং মানবসমাজের কল্যাণের লক্ষ্যে অংশগ্রহণমূলক দায়িত্ব পালনের চেতনা নিয়ে আমরা খ্রীষ্টান ও হিন্দু ধর্মের সকলেই যেন শান্তির কারিগর হয়ে উঠি; অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে এবং শুভাকাঙ্খি সকল মানুষের সা