রবিবার - ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ১২ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

পবিত্র ইদুল আজহা ও কোরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

পবিত্র ইদুল আজহা ও কোরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুফতি মাওলানা শামীম আহমেদ।

 

বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোতে পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হচ্ছে । সর্বোচ্চ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, যথাযোগ্য মর্যাদা, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ত্যাগের মহিমায় মুসলমানরা ঈদ পালন করবেন। ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা বিনম্র হৃদয়ে ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করবেন। নামাজ শেষে মহান রব আল্লাহতায়ালার উদ্দেশে পশু কোরবানি দেবেন। আল্লাহর জন্য নিজের জান-মাল ও প্রিয়তম জিনিস সন্তুষ্টচিত্তে বিলিয়ে দেওয়ার এক সুমহান শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর ঈদুল আজহা ফিরে আসে আমাদের মাঝে।

ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ঈদ শুধু আনন্দের উৎস নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটাই এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

বিষয়টি আমরা এভাবে দেখতে পারি, এলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সবার মধ্যে একাত্মতা ও সম্প্রীতি ফুটে ওঠে এবং ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান তখন আর প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুব্ধ হয়ে থাকে। ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল আজহায় যে কোরবানি দেওয়া হয়, তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কারণ কোরবানির রক্ত-গোশত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়। এই ঈদে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। তাই পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন। এটাই ঈদের শিক্ষা ও সার্থকতা।

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামী নিদর্শন ও অন্যতম ঐতিহ্য। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই হলো কোরবানির তাৎপর্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোরবানির পূর্ণ ফজিলত হাসিল করতে হলে মনের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে সেই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা ও ঐকান্তিকতাÑযা নিয়ে কোরবানি করেছিলেন আল্লাহর খলিল হজরত ইবরাহিম (আ.)। কেবল গোশত বিলানো ও রক্ত প্রবাহিত করার নাম কোরবানি নয়; বরং আল্লাহর রাস্তায় নিজের সম্পদের একটি অংশ বিলিয়ে দেওয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কোরবানি। গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। কেননা আল্লাহতায়ালার কাছে গোশত ও রক্তের কোনো মূল্য নেই। মূল্য আছে কেবল তাকওয়া, পরহেজগারি ও ইখলাসের। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে কখনো জবেহকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছবে না, পৌঁছবে কেবল তাকওয়া। সূরা হজ : ০৩

অতএব, আমাদের একান্ত কর্তব্য হলোÑখাঁটি নিয়ত সহকারে কোরবানি করা এবং তা থেকে শিক্ষা অর্জন করা। নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরিক করা। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর রাস্তায় নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ করার নাম কোরবানি। এটা ব্যক্তিগত কোনো ত্যাগের নাম নয়। এটা সামষ্টিক ত্যাগের প্রতিফলন। যেমন হজরত ইবরাহিম (আ.) একা এই কাজে অগ্রসর হননি। তার সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) এবং হজরত হাজেরা (আ.)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো মুসলমান শুধু একা আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিলে হবে না, তার পুরো পরিবারকেও ত্যাগের এ পথে নিয়ে আসতে হবে। এটাই সুন্নতে ইবরাহিম তথা কোরবানির মর্মকথা। কিন্তু আজ মুসলিম সমাজে কোরবানি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। আমরা ভুলে গেছি কোরবানির আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। লৌকিকতা আর আনুষ্ঠানিকতায় হারিয়ে গেছে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য। কোরবানি এখন হয়ে গেছে কিছু মানুষের গরু প্রদর্শনী, নির্বাচনী প্রচারাভিযান আর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির হাতিয়ার। এক কথায় কোরবানি এখন আর ত্যাগের শিক্ষায় মানুষকে উদ্ভাসিত করছে না, বরং অহমিকা প্রদর্শনীর মাধ্যম বা হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিয়ের প্রথম বছর মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে কোরবানি উপলক্ষে বিরাট গরু পাঠাতে না পারায় অনেকের ঘর-সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রমের খবরও পাওয়া যায়। অন্যদিকে ঢোল-বাদ্য সহকারে লাখ টাকায় কেনা উট-গরু প্রদর্শনীর মিছিলের কাছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে তালবিয়া ও তাকবিরের ধ্বনি। আমরা ভুলেই গেছি যে, আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত, রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তাকওয়া। সেই তাকওয়ারার চিত্র কি এমন? কী হবে জবাব? মনের মাঝে এসব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত না হলে, প্রশ্ন উত্থাপিত না হলে কী লাভ বছর বছর কোরবানি করে?

এক শ্রেণির মানুষ আছে যাদের কাছে কোরবানি নিছক ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোরবানি উপলক্ষে মৌসুমি পশু-ব্যবসা খারাপ কিছু নয়, বরং নিয়ত ঠিক থাকলে তা এক বিরাট ইবাদত। কিন্তু কোরবানি উপলক্ষে পশুর চামড়া নিয়ে যা হয় তার সঙ্গে সুন্নতে ইবরাহিমের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। কোরবানির সময় প্রতিবছর আমাদের দেশে চামড়া ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে ফেলে। এলাকায় দেখা যায়, একশ্রেণির মাস্তানের আনাগোনা। যাদের সামনে কথা বলার সাহস রাখেন না কোরবানিদাতারা। এরা নিজেরাই চামড়ার দাম ঠিক করে দেয় এবং কোরবানিদাতারা বাধ্য হয় ওই দামে তাদের হাতে চামড়া তুলে দিতে। অথচ কোরবানির চামড়ার হকদার এতিম, মিসকিন, গরিব মানুষরা। যারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়, কিংবা যারা চামড়া নিয়ে মাস্তানি করে তারা গরিবের হক নষ্ট করছে, এতিমের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। এটা জঘন্য অপরাধ। কিয়ামতের মাঠে তারা ছাড়া পাবে না। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা এতিম আর গরিবের পক্ষে তাদের হক আদায় করে ছাড়বেন।

যারা কোরবানির চামড়া নিয়ে মাস্তানি করে, যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পশুর মূল্য বাড়ায়, চামড়ার মূল্য ফেলে দেয় কিংবা যারা কোরবানিকে লোক দেখানো খেল তামাশায় পরিণত করে তাদের ভেবে দেখা উচিত, কিয়ামতের মাঠে প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের জন্য অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। ত্যাগের বার্তা নিয়ে প্রতিবছর আমাদের কাছে কোরবানি হাজির হয়। শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য, আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য যারা কোরবানি করেন, মাটিতে শোয়ানো পশুর গলায় ছুরি চালানোর পর গলা বেয়ে মাটিতে রক্ত পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। মনে রাখা দরকার, পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরে অবস্থিত পাশবিকতারও জবাই হয়ে যেতে হবে। তা না হলে গোশত খাওয়া ছাড়া কোরবানি দ্বারা আর কিছু অর্জিত হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

বস্তুত কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার, রিপুর তাড়না ও শয়তানের প্রবঞ্চনা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। তাই ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকেই কোরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানির মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn