বৃহস্পতিবার - ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ২৮শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ৯ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

লোকসংস্কৃতির মেলা, আবদুল জব্বারের বলী খেলা

লোকসংস্কৃতির মেলা, আবদুল জব্বারের বলী খেলা
মাহমুুদুল হক আনসারী
চট্টগ্রামের লালাদিঘীর ময়দানে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা। বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ এ বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলাকে সামনে রেখে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বিরাজ করে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা গাঁ গ্রামে বলী খেলা গরুর লড়াই , ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এসব মেলাতে এ অঞ্চলের মানুষের গৃহস্থলির নানা ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী বিক্রির জন্য আনা হতো। বছরব্যাপী এ পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলো নানাজাতের গৃহস্থলির জিনিসপত্র তৈরি করতো। সারা দেশের লালদীঘীর বলি খেলার সাদৃশ্যে লোকসংস্কৃতির মেলা জেলা উপজেলার ও গাঁ গ্রামে তিনদিন চারদিন এক সপ্তাহের জন্য বসতো। সেই লোকসংস্কৃতি ও খেলাসমূহ স্থানীয় জনগণ নানাজাতের ধর্ম গোত্র পেশার মানুষ উপভোগ করতো। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাঙালী জাতি এসব মেলাতে একাকার হয়ে আনন্দের সাথে সংষ্কৃতির নানা আয়োজন উপভোগ করে আসছে। বৃহদাকারে চট্টগ্রামের লালদীঘীর আব্দুল জব্বারের এ বলী খেলা।
তবে করোনার কারণে ২০২০-২১ বলী খেলাটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এবারের বলী খেলা আয়োজনের জন্য ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি সব প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা যায়। মুসলমানদের রমজান , ঈদ এবং বৈশাখী মেলা এবারে একত্রিত হয়ে গেল। তবুও বাঙালী সংষ্কৃতি ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা এবার লালদিঘী মাঠেই অনুষ্ঠিত হওয়ার সংবাদে স্থানীয় সংস্কৃতিমনা মানুষের মধ্যে স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বলীর রাজ্য হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম’। জব্বারের বলীখেলা সেই নামেরই প্রমাণ বহন করে চলেছে আজও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী বলা হয়। জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা এ জেলার লালদিঘী ময়দানে প্রতি বছর ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদেরকে বলা হয় ‘বলী’।
জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন। এই প্রতিযোগিতার শুরু ১৯০৯ সালে, যা আজও চলছে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হতো। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী ও লোকসংস্কৃতি মেলা।
মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতেন, তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই কুস্তি খেলার শুরু। কিন্তু আবদুল জব্বারের বলীখেলার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? কিভাবে এই প্রতিযোগিতার স্থান করে নিয়েছিল সারা দেশের মানুষের মনে? সেসব ইতিবৃত্ত নিয়ে আজকের লেখা।
১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা ‘জব্বারের বলী খেলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর আশেপাশের বলীরা সেই সময় মাস দুয়েক আগে এসে লালদিঘী ময়দানে জড়ো হতেন। জব্বার মিয়ার বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন তারা। সেখানেই তারা খাওয়া-দাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।
ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের নানা এলাকার বলী বা কুস্তিগীরেরা এই প্রতিযোগিতায় আসতে শুরু করেন। একসময় চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা – নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ নানা জায়গা থেকেও বলীরা আসতো। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে কুস্তীবীররা। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করার ইতিহাস আছে।
সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশের বলীরা আসতে থাকে। যখন প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হয় তখনই এর সম্পর্কে সবাই আরো ভালোভাবে জানতে পারেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রথম এর সম্প্রচার করেছিলো। এরপর এখন সকল টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করছে। আর গণমাধ্যমের আগ্রহের কারণে জব্বারের বলীখেলা সম্পর্কে আরো প্রচার বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে ব্যাপক মিডিয়ার প্রচার প্রসার হয়েছে। ফলে আব্দুল জব্বারের বলী খেলা বাংলাদেশ নয় দেশের বাইরেও ব্যাপকভাবে লাইভ সম্প্রচার হয়। জব্বারের বলীখেলা বাংলাদেশী মানুষের যেখানেই যেদেশেই বসবাস তারা আগ্রহের সাথে খেলা উপভোগ এবং খবরাখবর রাখার অপেক্ষায় থাকে। সুষ্ঠু এবং সুন্দরভাবে খেলাটি সুসম্পন্ন হোক স্থানীয় প্রশাসন জনপ্রতিনিধি এবং সংস্কৃতি মনা মানুষের প্রত্যাশা।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn