
সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে মানববন্ধন, ইউএনও’র বিরুদ্ধে নতুন বিতর্ক
সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসের দায়িত্ব ফেলে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মানববন্ধন করানোকে ঘিরে নতুন বিতর্কে জড়িয়েছেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মো. রাসেল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদে প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (২৭ এপ্রিল) সকাল ১০টায় তালা ডাকবাংলোর সামনে প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইউএনও শেখ রাসেলের বিরুদ্ধে চলমান অনিয়মের অভিযোগ এবং সম্ভাব্য বদলি ঠেকাতে কিছু ঠিকাদার ও রাজনৈতিক কর্মী মানববন্ধনের আয়োজন করেন। মানববন্ধন সফল করতে ঠিকাদারদের অর্থায়নে দলীয় কিছু নেতাকর্মীকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন তালা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মৃণাল কান্তি রায় এবং সঞ্চালনায় ছিলেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইদুর রহমান।
এতে বক্তব্য রাখেন তালা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সফিকুল ইসলাম, ইউপি চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু, অধ্যাপক গোলাম ফারুক, জাহাঙ্গীর হোসেন, কলেজ শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মোশারাফ হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, মাধ্যমিক শিক্ষক নেতা জগদীশ হালদার, আদর্শ শিক্ষক পরিষদের নেতা অধ্যাপক আজিজুর রহমান, কেন্দ্রীয় ডিএসডি নেতা মীর জিল্লুর রহমান, তালা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ হাকিম, নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম এবং ইমাম পরিষদের নেতা মাওলানা তাওহিদুর রহমান প্রমুখ।
বক্তারা ইউএনও রাসেলের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বলেন, তিনি তালায় যোগদানের পর থেকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তার নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
এর আগে, গত ২২ এপ্রিল তালা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের ৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিক রোকনুজ্জামান টিপুর সঙ্গে উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী এমএম মামুন আলমের কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের জেরে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকসহ স্থানীয়দের সাক্ষ্য গ্রহণ করে সাংবাদিক টিপুকে ১৭৬ ধারায় ১০ দিনের কারাদণ্ড ও ২০০ টাকা জরিমানা করেন। ঘটনার পর সারাদেশে সাংবাদিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় ইউএনও রাসেলের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এদিকে, একই সময়ে তালা উপজেলা পরিষদ চত্বরে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যানারে ইউএনও রাসেলের পক্ষে আরেকটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এই মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন তালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাজিব সরদার এবং সঞ্চালনায় ছিলেন উপজেলা প্রকৌশলী রথীন্দ্র নাথ হালদার। বক্তব্য রাখেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন্নাহার, কৃষি কর্মকর্তা হাজিরা খাতুন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কামাল হোসেন, উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ও একাডেমিক সুপারভাইজার প্রভাষ কুমার দাশ প্রমুখ।
সরকারি কর্মকর্তাদের মানববন্ধনে অংশ নেওয়ায় তালার সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সরকারি দপ্তরের কাজ বাদ দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক আমলার পক্ষে মানববন্ধন করাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ভূমি অফিসের নায়েবদের মানববন্ধনে অংশ নেওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটা নতুন করে একটি উস্কানি সৃষ্টি করছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস টাইমে অফিস থেকে বাইরে বের করে এনে ইউএনওর পক্ষে মানববন্ধন করানো এটা অযৌক্তিক। এবং আজকে এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছিল, কেন্দ্রের পাশেই উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে তারা প্রোগ্রাম করেছে, এগুলো যুক্তিসঙ্গত নয়। এছাড়াও ইউএনওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা—তিনি বেআইনিভাবে সাজা প্রদান করেছেন। এবং এটা সবাই একপাক্ষিক করেছেন যে, এটি আইনসঙ্গত হয়নি। উনি বেআইনি এই রায়টা দিয়েছেন। অর্থাৎ বেআইনিভাবে উনি যে রায়টি দিয়েছেন সেখানে আইনের যথাযথ বিধানগুলো যথার্থ প্রয়োগ না করে তিনি একজন সাংবাদিককে এইভাবে শাস্তি দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে বিষয়টা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার নতুন করে উনি নিজের পিঠ বাঁচাতে উস্কানির জায়গা তৈরি করছেন। আমি ওনার ফেসবুক আইডিতে দেখেছি, উনি ওনার পক্ষে যারা মাঠে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি এটি করতে পারেন না। তিনি যেটা করছেন সেটি ঠিক না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও শেখ মো. রাসেল বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য ও মনগড়া। একটি উপজেলার সব রাজনৈতিক দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে আপনি কি টাকায় কিনতে পারবেন? তারা সবাই এখানে এসেছে এবং বিশেষ করে যারা আমাকে চেনে, স্থানীয় আশেপাশের যে ব্যবসায়ীরা আছেন, বাজারের ব্যবসায়ী সবাই আমাকে চেনে। এই বাজারের একটি খাল কেটেছি। এছাড়াও দৃশ্যমান কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছি, যার কারণে তারা দোকান থেকে বের হয়ে সামিল হয়েছেন, আমি দেখেছি এবং শুনেছি।
সরকারি কর্মকর্তাদের মানববন্ধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের অফিসের সামনে মানববন্ধন হয়েছে। আমি পরে ছবি দেখেছি, আমাদের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানরা সেখানে দাঁড়িয়েছেন। সরকারি ১৭টি হস্তান্তরিত ডিপার্টমেন্ট এবং আরো ৮টি ডিপার্টমেন্ট—মোট ২৫টি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। সরকারি অফিসাররা কি বেতন পায় না নাকি? তারা অবশ্যই তাদের নিজেদের সেফটির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। কারণ, তাদেরই একজন সহকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, যার কারণে আমি হেনস্তার শিকার হয়েছি।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, মানববন্ধনের বিষয়ে আমি শুনেছি। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, পরে জামিন দেওয়া হয়েছে। কেউ তো আর আইনের ঊর্ধ্বে না। যেহেতু আমি ইমোশনালি—আপনি সাংবাদিক, আমি জেলা প্রশাসক—এটা তো কোনো ব্যাপার না। আমার কাজটা যেন সঠিক হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ইউএনও রাসেলের বিরুদ্ধে মানববন্ধন আয়োজনের জন্য টাকা ছড়ানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ইউএনও’র কি এত টাকা-পয়সা হয়ে গেছে নাকি যে টাকা-পয়সা দিয়ে মানববন্ধন করাবে? কারণ, সে আজ আছে, কাল নেই। কালকে অর্ডার হলে সে চলে যাবে। আমি মনে করি, কেউ যেন অন্যায় না করে।