শনিবার - ২৮শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ১৪ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ৩রা মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

বেনাপোল-যশোর রোডে দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন জুঁই : দিনভর আলোচনা-এতরাতে কোথায় যাচ্ছিলেন তারা

বেনাপোল-যশোর রোডে দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন জুঁই : দিনভর আলোচনা-এতরাতে কোথায় যাচ্ছিলেন তারা

বেনাপোল- যশোর রোডে মধ্যরাতে প্রাইভেটকারের সঙ্গে গাছের ধাক্কায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন ও তার সহযাত্রী সুজলপুর গ্রামের আরিফিন আক্তার জুঁই নিহত হয়েছেন। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা যশোরের আলোচিত সদর উপজেলার এড়েন্দা এলাকার মাসুদ রানা ও তার বন্ধু ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালি বেতাগা গ্রামের মামুন গুরুতর আহত হয়েছেন। বুধবার ২৫ জুন দিবাগত রাত ৪টার পর সদর উপজেলার নতুনহাট বাজার সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, এ খবর ছড়িয়ে পড়লে একদিকে যশোরে যেমন শোকের ছায়া নেমে আসে তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও নানা প্রশ্ন উঠে আসে। এত রাতে কেন তারা ওই পথে যাচ্ছিলেন? যাঁরা যাচ্ছিলেন, তাদের পরস্পরের সঙ্গে কী সম্পর্ক এসব বিষয় নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবারই কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহত জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজী, অজ্ঞাত পিকআপ চালকের বিরুদ্ধে। এ মামলাকে ঘিরেও তৈরী হয়েছে রহস্য।
স্থানীয়রা জানান, রাত চারটার পর হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান তারা। দ্রুত রাস্তায় এসে দেখেন, কালো রঙের প্রাইভেটকারটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে আছে। গাড়িটির স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন জুঁই নিজেই। তার পাশের সিটে বসা ছিলেন মিলন। জুঁইয়ের শরীরের অর্ধেকের বেশি অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়; দুই চোখ বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে, মিলনের মাথার তালু ফেটে যায় এবং পা ও হাত ভেঙে যায়। পেছনে থাকা দুজনের অবস্থাও ছিল গুরুতর। গাড়ির ইঞ্জিন ছিটকে অন্তত ২০ হাত দূরে চলে যায়। দ্রুত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থল থেকেই দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় এবং অপর দুইজনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে যশোরে। সকালে মরদেহগুলো নিজ নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে, এই ঘটনা ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধতে থাকে। গাড়িটি কার, কে চালাচ্ছিলেন, তারা এত রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন এবং তাদের পরস্পরের সম্পর্ক কি ? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে সাধারণ জনগণ।

এ বিষয়ে দিনব্যাপী অনুসন্ধানে নানা তথ্য উঠে আসে। জানা যায়, বছর খানেক আগে যশোরের এড়েন্দা বাজারে মাসুদ রানার আরেকটি গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে, যেখানে এক নারী ও এক পুরুষ নিহত হন। বুধবারের দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটিও ছিল তার মালিকানাধীন। কে এই মাসুদ রানা তা জানতেই উঠে আসে নানা রহস্য। স্থানীয়রা জানান, চিত্রা সিনেমা হলের সাবেক কর্মচারী মৃত নূর ইসলামের ছেলে মাসুদ রানা নৌবাহিনীতে চাকরি পান। কয়েক বছরের মধ্যে চাকরিচ্যুত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন এবং শুরু করেন ‘চাকরি দেওয়ার ব্যবসা’। সাধারণ মানুষকে নানা প্রলোভন দিয়ে টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে অল্প সময়েই কোটিপতি বনে যান।

কেউ কেউ জানান, মাসুদ রানার চার-পাঁচটি মূল্যবান গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি ব্যবহার করে তিনি স্বর্ণ পাচারে জড়িয়ে পড়েন। কয়েক বছর আগে র‌্যাবের স্পেশাল টিম ঢাকায় অভিযান চালিয়ে মাসুদের বাড়ি থেকে তাকে আটক করে। কিছুদিন জেল খেটে আবার যশোরে ফিরে আগের মতই চলাফেরা শুরু করেন।

বিশেষ করে, মধ্যরাতে তার গাড়িগুলো বেনাপোল রুটে চলাচল করে এবং এসব কর্মকাণ্ডে নারীদের ব্যবহার করা হয়,এমন অভিযোগও রয়েছে। মাসুদ রানা বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক। এমনকি গত ইউপি নির্বাচনে তিনি দেয়াড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। অনেকেই মনে করছেন, সেদিন রাতেও তারা কোনো গোপন কাজেই যাচ্ছিলেন।

আহত মামুন সম্পর্কেও নানা তথ্য উঠে এসেছে। জানা যায়, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালি বেতাগা গ্রামের মামুন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। সাবেক এমপি শেখ তন্ময়ের এক পিএস-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাসুদের ব্যবসায়িক সহযোগী হিসেবে কাজ করেন এবং বর্তমানে যশোরে থেকে মাসুদের সঙ্গেই ব্যবসা পরিচালনা করেন।
নিহত ছাত্রলীগ নেতা মাসুদুর রহমান মিলনকে নিয়েও নানা মতামত পাওয়া গেছে। কেউ বলেন, তিনি ভদ্র ও মার্জিত ছিলেন, অনেকে আবার অভিযোগ করেন, তিনি বিএনপি নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে জুয়া ও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার আড়ালে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা জানান, রাত ২টায় তিনি বাড়ি ফেরেন এবং ৩টার দিকে একটি ফোন পেয়ে আবার বের হয়ে যান। সকালে তার মরদেহ স্টেডিয়ামপাড়ার বাড়িতে পৌঁছায়।
নিহত জুঁইকে ঘিরেও নানা তথ্য উঠে আসে। তিনি যশোরে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। ফেসবুক ও টিকটকে নিয়মিত সক্রিয় ছিলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গাড়িতে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। রাতবেরাত তার চলাফেরা ও অশালীন অঙ্গভঙ্গি ছিল স্থানীয়দের আলোচনার বিষয়। স্বামীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বেশিরভাগ মানুষ দাবি করেন, নিহত ও আহতরা মাদকাসক্ত ছিলেন এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অনেকবার ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে।
এদিকে, জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজী মামলায় উল্লেখ করেন, তার স্ত্রী ব্যবসায়িক পার্টনার মিলনের সঙ্গে ঝিকরগাছায় যাচ্ছিলেন। সে সময় পেছন দিক থেকে আসা একটি অজ্ঞাত পিকআপ তাদের গাড়িকে ধাক্কা দেয়, যার ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে। তবে স্ত্রীর কী ধরনের ব্যবসা ছিল সে বিষয়ে মামলায় কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি। এ বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। মামলায় আরও বলা হয়, নিহতদের পরিবারের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়, যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসনাত বলেন, ঘটনার পর থানায় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। এখনি কিছু বলা যাচ্ছে না।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn