বগুড়ায় সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের আলোচনা সভা
২৬ জুন ২০২৫ (বৃহস্পতিবার) দুপুর ২.৩০ টায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বগুড়া জেলা কমিটির উদ্যোগে বগুড়া প্রজা বাহিনী লেন, বাসাদ কার্যালয়ে ১৭০তম সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বগুড়া জেলার সভাপতি শ্রী সন্তোষ সিং বাবু এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এ্যাডঃ মোঃ ছাইফুল ইসলাম (পল্টু) আহ্বায়ক বগুড়া জেলা বাসদ, অদিবাসী বিষয় আলোচনা করেন শ্রী যুগেশ চন্দ্র সিং সাবেক সভাপতি জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বগুড়া বগুড়া জেলা কমিটি। মোঃ লিটন হক, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান যুগ্ম সম্পাদক বগুড়া জেলা
আরও বক্তব্য রাখেন দিপক মারর্ডি, সাংস্কৃতিক সম্পাদক জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বগুড়া জেলা কমিটি, শ্রী গৌতম মাহাতো সভাপতি নন্দীগ্রাম উপজেলা,স্বপন কুমার সিং আহ্বায়ক শেরপুর উপজেলা, প্রভাব মালো সভাপতি গাবতলী উপজেলা, মোঃ রাসেদুল ইসলাম রাসেদ উপদেষ্টা শেরপুর, পলাশ বাগদি সাধারণ সম্পাদক ধুনট উপজেলা, মহন কুমার মালো প্রমুখ।
সমতল ভূমি'র বগুড়া জেলা সাওতাল, তুরি, মাহাতো, মুসহর, ভুমিজ, লহার, ওরাও, গঞ্জু সহ প্রায়ই ১৩টি
জনগোষ্ঠী বগুড়াতে বসবাস করে আসছে। হারিয়েছে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, বিলপ্ত হয়েছে ভ‚মি অধিকারও, জোর করে পারমিশন ছাড়াই অধিবাসীদের জমি করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাই রাষ্টকে অদিবাসীদের পাশে
এগিয়ে আসার আহ্বায়ন রাখেন বক্তরা। বাংলাদেশ স্বাধীনদেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশের পূর্বে এটা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশেরই অংশ।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ভারতীয় জনগণের অদিখার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তথা
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসের এক বিশাল অংশ জুড়ে সংখ্যালঘু আদিবাসী জাতি সমূহের
লড়াই সংগ্রাম ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা অথবা এদেশের আদিবাসী হিসেবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবী সংগ্রামী উপাদান এদেশের সংগ্রামের প্রধান ধারার সাথে সব সময়ই যুক্ত ছিল। পাকিস্তানী চরম সাম্প্রদায়িক শাসনের শুরু থেকেই এই আদিবাসীরা সংগঠিত ভাবে লড়াই
করেছে। তেভাগা সংগ্রাম কিংবা যে নামেই পাকিস্তানী আমলে এই সংগ্রামগুলিকে চিহ্নিত করা হোক না কেন
আদিবাসীদের ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল ও আপোষহীন। এই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল সহ নওগাঁর
লালমাটি পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্বাক্ষর বহন করে। সমগ্র উত্তর বাংলাদেশে তেভাগার সংগ্রামের সঙ্গেও গভীর ভাবে যুক্ত ছিল দিনাজপুর থেকে রাজশাহী অঞ্চলের ব্যাপক আদিবাসী কৃষকরা।
পাকিস্তানী শাসন আমলে হাজার হাজার আদিবাসীকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। পাকিস্তানী কুশাসনের উজ্জ্বল প্রমাণ মেলে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আদিবাসী বন্দী হত্যার ঘটনায়। পঞ্চাশের দশকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বহু বন্দীকে হত্যা করা হয় এবং তাদের এক বিশাল অংশকে গণকবর দেয়া হয় কেন্দ্রীয় কারাগারের করারক্ষী ব্যারাকের নিকট এদেশের মাটিতে আদিবাসীদের সংগ্রামের এই রক্তাক্ত ইতিহাস সংরক্ষণের ও তার তদন্তের কোন উদ্যোগ রাষ্ট্র কখনও গ্রহণ করে নাই। কারণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী যতই এ দেশাত নিজের দেশ মান করুক না কেন রাষ্ট্র তাদের এদেশের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কখনই বিবেচনা করেনি এখানেই থাকছে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে এ জাতি সমূহের চেতনাগত সংহতির দূর্বলতা এখা বর্তমান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশের দুর্বলতা। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ারগর বাঙ্গালীদের সাথে ক্ষুদ্র-জাতিসমূহও অর্জন করবে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি এটাই ছিল তাদের প্রত্যাশা। প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও তাদের নিজস্ব জীবনবোধ। কিন্তু এ প্রশ্নে স্বাধীন বাংলাদেশেও আদিবাসীরা থেকে গেল উপেক্ষিত
বৃহৎ জাতির পাশে থেকে বিভিন্ন আগ্রাসন আদিবাসীদের করে তুললো বিপন্ন, উচ্ছেদ করতে থাকলো জীবিকার সকল ক্ষেত্র থেকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বা আদিবাসী গোষ্ঠী দুটি পৃথক ভৌগলিক পরিবেশে বসবার করে। এই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেই প্রায় ১৫ লক্ষাধিক আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। পার্বত্য জেলা
সমূহের আদিবাসীদের সমস্যাবলীর বৈশিষ্ট্য থেকে উত্তরাঞ্চলের সমস্যাবলীর ধরণ ও প্রকৃতি কিছুটা আলাদা। রক্তাক্ত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পর আমাদের জাতীয় জীবনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নই মূল সমস্যা হিসেবে সম্মুখে এসে যায়। ফলে পার্বত্য এলাকায় কি করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় এটাকে কেন্দ্র করেই সমগ্র জাতি ভাবিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ভাতৃঘাতি যুদ্ধ অবসানের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। পার্বত্য এলাকার জনগণের জন্য পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এটা একটা অগ্রগতি। কিন্তু এই উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের উপর চলছে নীরব নির্যাতন, অবহেলা ও শোষণ। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি আইনে জটিল ষড়যন্ত্রে প্রতিনিয়ত করা হয় উচ্ছেদ। আদিবাসীরা দরিদ্র বিধায় আইনের আশ্রয় কিংবা আইনকে আত্মরক্ষার কাজে লাগাতে পারে না। বিলম্বিত ও আইনের দুর্বল প্রয়োগে আদিবাসীদেরকে করেছে আরও অসহায়। সংগঠিত জমি জালিয়াত চক্র ও দুর্নীতিগ্রন্থ প্রশাসন ঐক্যবদ্ধভাবে আদিবাসীদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত সামাজিক নির্ঘাতন, যেমন আক্রমণ হত্যা, উচ্ছেদ, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, অপহরণ, মিথ্যামামলা এমনকি বাড়ি-ঘরে অগিসংযোগের ঘটনাও বিরল নয়। আদিবাসী গ্রামগুলির জন্য বিশেষ নিরাপত্তা কিংবা দরিদ্র আদিবাসীদের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের বিশেষ দায়িত্ববোধ কখনই ছিল না বা এখনও নেই। তার ফলে এখন কি চলছে সহজেই অনুমান করা যায়। অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের সংকট সমাধানে এখনও রাষ্ট্রীয়া ও প্রশাসন অনুপস্থিত। অভীতের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী ১৯৯৩ সাল থেকে নয় দফা দাবীর ভিত্তিতে সংগ্রাম ও আন্দোলন করছে। এই নয় দফা দাবীর সংগ্রামের ভিডিতেই ও সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ গড়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নয় দফা দাবীর ভিত্তিতেই কতকগুলি বিষয় সম্মুখে নিয়ে আসা জরুরী। কারণ পার্বত্য চুক্তি হওয়ার প্রেক্ষিতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আদিবাসীদের সমস্যা ও সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা দরকার। সে কারণে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করছে। সংখ্যালঘু জাতিসমূহ অর্থাৎ আদিবাসীদের সমস্যাবলী মৌলিকভাবে সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্যমত প্রয়োজন।