
বই-বহি-অহি
ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
আলো যে ভাবে অন্ধকার দূর করে বইও আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে। শিক্ষায় পড়া আর লেখার সমন্বয় থাকতে হয়। লেখার জন্য প্রয়োজন হয় কলমের। মহান আল্লাহ পাক কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের একটি সূরার নামকরণ করা হয় ‘আল কলম’। লিখিত ও গ্রন্থিত বস্তুকে বলা হয় বই বা পুস্তক। মহান আল্লাহ পাকের বাণীর নাম ‘কোরআন’। কোরআন শব্দের অর্থ অধ্যয়ন। এই কোরআনকে কিতাবও বলা হয়। কিতাব শব্দের অর্থ হলো গ্রন্থ বা বই। বই শব্দটি এসেছে ‘বহি’ হতে আর বহি শব্দটি এসেছে ‘অহি’ (মহান আল্লাহর প্রত্যাদেশ) হতে। বইয়ের সাথে রয়েছে অহি জ্ঞান সংযোগ। অহির জ্ঞান, কলমের মাধ্যমে বইতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই কলমের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে কলমের শপথ গ্রহণ করেছেন।
আমার ভিতর একটা ‘আমি’ আছে। বই পড়তে পড়তে যখন একটা মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয়ে যায়, তখন বইয়ের জগৎ হতে তাকে দূরে রাখা তাঁর মৃত্যু সমতুল্য। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘আমাকে মারতে চাইলে চাকু ছুরি কিংবা কোনো পিস্তলের প্রয়োজন নেই, বরং আমাকে বইয়ের জগৎ থেকে দূরে রাখো’। বইয়ের মাধ্যমে যাঁরা আলোর সন্ধান পান তাদেরকে হত্যা করতে হয় না, তাদের বইয়ের জগৎ হতে দূরে রাখলে তারা মানসিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেন। শারীরিক আঘাত হতে যেমন মানসিক আঘাত বড় যন্ত্রণাদায়ক তদ্রুপ শারীরিক মৃত্যুর চেয়ে মানসিক মৃত্যু বড় কষ্টদায়ক। মানুষের মনে হাজারো চোখ আছে, একটি একটি বই পড়ার মাধ্যমে একটি একটি অন্তরের চোখ খুলে যায়। ফরাসী দার্শনিক আনাতোল ফ্রাঁস বলেছেন, ‘বই পড়ার মাধ্যমে আমরা মাদির মতো চারদিকে অজস্র চোখ ফুটিয়ে তুলতে পারি’। যে চক্ষু দ্বারা আমরা বহুকিছু দেখতে পারি, যা কপালের চোখ দ্বারা দেখা সম্ভব নয়। সারা দুনিয়া এখন জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোয় আলোয় আলোকিত। এসব বাইরের আলো। ভিতরটা আলোকিত করতে না পারলে সব উন্নতিই হবে টিউমারের মত। যত বড় হবে তত সমস্যা বাড়বে। এক সময় ঢাকায় আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো হতে আমরা দুর্লভ বই খুঁজে নিতাম। বর্তমান একে একে হারিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরীগুলো।বইয়ের দোকানগুলো দখল করছে শাড়ি, ত্রিপিচ জুতার দোকান। বই মস্তিস্ক বিকাশ করে। মাথার মস্তিস্কের পরিবর্তে দখল করে নিচ্ছে পাদুকা। মাথার চেয়ে পায়ের দাম যে জাতির নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে সে জাতি কখনো সভ্যতার পথে চলতে পারে না। এটি আমাদের ভোগবাদী সমাজের চরিত্র। অনেকে বলেন, নেটে বই পাওয়া যায়, তা সত্য কিন্তু কতজন মানুষ নেটে বই পড়ে? মানুষ নেটে দেখে, লেখে না, নেটে চিন্তা করে না। ভাবনার জগৎটা নেট সঙ্কোচিত করেছে। ইন্টারনেট জগৎ প্রজন্মের
হাতের মুঠোয় ভালো-মন্দ সবকিছু নিয়ে এসেছে। এমনি সময় তরুণ সমাজ মাথাঠিক রেখে, চলা কঠিন। কারণ নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ অধিক থাকে।তাই নেটে বই পাওয়া যায় এটি সত্য কিন্তু নেটের বইয়ের পাঠক পাওয়া কষ্ট কর। বইয়ের পাঠক ও দোকানের সংখ্যা কমলেও ঢাকার বইমেলায় (২০২৪ সালের বইমেলার হিসেব অনুযায়ী)প্রতি বছর কম বেশি ৫ কোটি টাকা করে বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। উৎসবে সখের বসে বই কিনলেও আমি বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। পৃথিবী ব্যাপী কাগজের ছাপানো বইয়ের সংখ্যা যখন কমছে তখন বাংলাদেশে বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে। ঘর সাজানোর পণ্যের প্রসারের সাথে মন সাজানোর পণ্যে প্রসার হওয়া ক্ষুদ্র নিউজ নয়।
বড় বড় ডিগ্রীধারি বহু মানুষ বই পড়ে না,তারা বর্তমান দুনিয়ার শিক্ষিত মূর্খ। সাহিত্যিক অধ্যাপক আহসাব উদ্দিন আহমদ বলতেন, ‘যে সকল শিক্ষিত
ব্যক্তি বই পড়ে না, তারা নিজের মনকে উপবাসে রাখার অপরাধে অপরাধী। তাদেরকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত লোক বলা যায় না।’
সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, ‘যারা লেখাপড়া জানে না শুধু তারাই মূর্খ নয়, যারা বুঝতে চায় না, বই পড়ে না, জানতে চায় না, প্রশ্ন করতে পারে না, যাদের জ্ঞান তৃষ্ণা নেই তারাও মুর্খ।’
বইয়ের স্বাদ গন্ধ আজকের প্রজন্ম পায় কিনা আমার জানা নেই। ছাত্রজীবনে রাজধানীর বুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের দোকানে ঘুরে যখন প্রিয় বইটি খুঁজে পেতাম তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বইয়ের পৃষ্ঠার সুগন্ধ নিতে বই খুলে বার বার নিঃশ্বাস নিতাম। নতুন বইয়ের সুগন্ধীর চেয়ে কোন পারফিউমের স্মাইল আমার নিকট প্রিয় ছিল না।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের কথাটি মনে পড়লো, তিনি লেখেছেন, ‘মাকে সামাজিক যোগাযোগে শুভেচ্ছা জানানো, আর মায়ের আঁচলে নিজের মুখ মোছা, দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য। মা খুশি হবেন দ্বিতীয়টিতে দ্বিতীয়টি বাস্তব, যাতে মায়ের স্পর্শ লেগে থাকে। তেমনি ভাবে কাগজের বই আর পত্রিকার জগৎ বাস্তব ব্যাপার। ই-বুক, ই-পেপার নয়’।
বই তো আনন্দের সামগ্রী। এখন আমরা কতজন শিক্ষিত মানুষ বইয়ের স্বাদ পাই! গাদা গাদা বই পড়ে যখন দার্শনিক, সাতিহ্যিক, পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, বৈজ্ঞানিক হওয়ার সময় তখন আমরা বই পড়ি না, অথচ যেসব শিশুর বই পড়ার ক্ষমতা অর্জন হয়নি তাদের কাঁধে প্রচুর বই তুলে দিয়ে শিশুর শৈশব নষ্ট করে ছাড়ছি। তাদের আমরা খেলতে খেলতে খেলোয়াড়, আর জানতে জানতে জানোয়ারে পরিণত করছি। বর্তমান একজন শিশু ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করি, তোমার স্কুলের বইয়ের সংখ্যা কত? সে না গুনে উত্তর দিতে পারবে না। অনেক শিশুকে শৈশবে জোর করে শিক্ষা গিলাতে গিয়ে শিক্ষায় অরুচি আসে। আনন্দের শিক্ষায় কোন শিশুর একবার অরুচি আসলে, পুনরায় রুচি ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন।
পৃথিবীর সব জ্ঞান ভাণ্ডারের মূল উৎস বই। বইয়ের কাছ হতে দূরে থাকা মানে জ্ঞান ভাণ্ডার হতে দূরে থাকা। একটি ভালো বই যে কোন মানুষের মনে বিপ্লব ঘটাতে পারে। চিন্তা চেতনার আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। বইয়ের ক্ষমতা অসীম। তার ক্ষমতা আত্মত্মস্থ করা আমাদের জন্য কঠিন। সঠিক ভাবে আত্মস্থ করতে পারলে বইয়ের একটি লাইন একটা জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে।আজকের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আর জীবনের ক্যারিয়ার গঠন করতে শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে জীবনটাকে বন্দী করে রাখে। পাঠ্য পুস্তকের বাইরে জ্ঞানের বিশাল জগতে প্রবেশ করতে, জীবনবোধের জ্ঞান অর্জন করতে বহু সহায়ক গ্রন্থের প্রয়োজন হয়, তা আমরা বুঝতে চাই না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার করিলে পেট ভরে: কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। তেমনি একটি শিক্ষা পুস্তককে রীতিমত হজম করিতে অনেকগুলো সহায়ক পুস্তকের সাহায্য আবশ্যক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট একজন জানতে চাইলেন, ভালো বই কোনটি? তিনি উত্তরে জানালেন, যে বই পড়ার সময় মনে থাকে না. বই পড়তেছি, সেটি ভালো বই। বই পড়ার সময় দারুণ একটা কল্পনা শক্তি সৃষ্টি হয়। ছাত্র জীবনের যখন বই পড়তাম তখন পড়তে পড়তে একটা কল্পনার জগৎ তৈরি হয়ে যেতো। ‘বীরপুরুষ’ কবিতা পড়তে গিয়ে ভাবতাম ‘ইস’। আমি যদি এ ধরনের বীরপুরুষ হতে পারতাম। যদি হতে পারতাম জগৎ বিজয়ী এক পুরুষ। এ ধরনের কল্পনা শক্তি একটা তরুণের জীবনে বিপ্লব এনে দিতে পারে।
আইনস্টাইন বলেছেন জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তি অনেক বড়। আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু ছাত্রদের মনে এ ধরনের কল্পনা শক্তি জাগ্রত করতে পারছি না। দেখার জগৎ প্রসারিত হচ্ছে কিন্তু চিন্তার জগৎ সঙ্কোচিত হচ্ছে। মানুষের পাওয়ার পয়েন্ট হলো মানুষের মন। মনের পরিবর্তনই প্রকৃত পরিবর্তন। মনকে সুন্দর করতে মহামনীষীদের সুন্দর মন হতে সৌন্দর্যের সৌরভ ধারণা করতে হয়। জেমস রাসেল বলেছেন, ‘বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য নিয়ে আসে’।
মেধা মনন প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটাতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে লাইব্রেরীর গুরুত্ব কম নয়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি লাইব্রেরীকে স্কুল কলেজের ওপর স্থান দিতে চাই, এই কারণে যে, এখানে লোকেরা স্বেচ্ছায় স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়, প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে, জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক