আদর্শ ও আলোকিত মানব গঠনে মাইজভান্ডারীয়া তরিকা
পীরজাদা সাইফুল্লাহ ফারুকী চরণদ্বীপি
স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা জীব মানবকে আল্লাহ তায়ালা ভূধারায় প্রেরণ করেছেন প্রতিনিধিরূপে (খলিফা)। স্বীয় কুপ্রবৃত্তি ও পারিপার্শ্বিক জাগতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মানব কখনো কখনো স্বীয় সৃষ্টিকর্তা ও স্রষ্টা কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে চাকচিক্য মরিচিকায় বিভ্রান্ত হয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে পশুবৎ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেক জাগ্রত পূর্বক লক্ষ্যহীন মানবকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তথা স্রষ্টার নৈকট্যতা অর্জনের মাধ্যমে আদর্শ ও আলোকিত মানবে পরিণতকরণে কোরআন সুন্নাহর আলোকে সঠিক দীক্ষা প্রদান করে আসছে আওলাদে রাসুল (দঃ), গাউসুল আজম হজরত শাহসুফী সাইয়্যিদ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত মাইজভান্ডারীয়া তরিকা যুগ যুগ ধরে। গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) ও মাশায়েখে তরিকায়ে মাইজভান্ডারীয়া (কঃ)'র বেলায়তী জীবনধারা ও অমৃতময় বচনে পরিদৃষ্ট হয় যে, আদর্শ ও আলোকিত মানব গঠনে ব্যক্তিকে ত্রিবিধ সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হয়। এক. সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি, দুই. স্বীয় অস্তিত্বের প্রতি, তিন. স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি।
এক. আল্লাহর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী : বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহর তায়ালার সৃষ্টি হিসাবে তাঁরই অস্তিত্বের প্রতি নিরংকুশ বিশ্বাস ও পার্থিব আকর্ষণ পরিত্যাগ করতঃ কেবল তাঁরই আকর্ষণে সর্বাবস্থায় প্রেমময় সুদৃঢ় বন্ধন মানবকে স্রষ্টার প্রতি সম্পর্ক বিনির্মাণের মাধ্যমে আদর্শ ও আলোকিত মানবে পরিণত হতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনে ব্যাপক গবেষণা করা প্রয়োজন নেই, কেবল চর্মচক্ষু ও অন্তচক্ষুর মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি আনুগত্যপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপিত হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, "তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জ্ঞানবানদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন। (সূরা রূম, আয়াত নং : ২২)। উপমাস্বরূপ চক্ষুর সম্মুখে দৃশ্যমান একটি গাছের দিকে তাকিয়ে ইহার অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব, কেইবা ইহার সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি অনুসন্ধিৎসু ভাবুক মনে প্রাপ্ত উত্তরই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁরই পরিচিতি (মারেফত) অর্জনে যথেষ্ট। তাইতো পারসিক ভাবুক কবি আল্লামা শেখ সাদী বলেন, ‘বরগে দরখ্ তান সব্জে দর নজরে হুসিয়ার - হার ওয়ারাকশ দপ্তরাস্ত মারফতে কেরদেগার।’ অনুবাদ: সবুজ গাছের পাতা জ্ঞানী লোকের সচেতন দৃষ্টিতে এমন যে, প্রতিটি পাতা স্রষ্টার পরিচিতির এক একটি গ্রন্থ। অর্থাৎ আল্লাহকে জানার জন্য সহস্র খন্ড হাদিস ও দর্শন শাস্ত্রের প্রয়োজন হয় না, ঐ যে সুচিত্রিত পল্লব রাজি তা জ্ঞানীর নয়নে মাহাত্ম্যপূর্ণ এক একটি মহাগ্রন্থ স্বরূপ। কেবলমাত্র তা নয়, আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টি ব্যতিরেকে ব্যক্তি স্বীয় শরীরের প্রতি দৃষ্টিপাতে আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনাবলী দর্শনে আল্লাহর তায়ালার অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর পরিচিতি (মারেফত) অর্জন করতে সমর্থ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, "আর বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে আমার নিদর্শনাবলি এবং স্বয়ং তোমাদের মাঝেও। সুতরাং তোমরা কি অনুধাবন করবে না? আকাশে বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে তোমাদের জীবনোপকরণ ও তোমাদেরকে যা কিছুর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। (সূরা যারিয়াত, আয়াত নং : ২০-২১) তাই তো চিশতীয়া তরিকার শায়খ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী আজমীরি (রঃ) বলেন, 'জামালে শাহেদে জান বী ওয়ারায়ী পর্দায়ে চাক - চুনা কে নুরে খোদা আয ওয়ারায়ী আলেমে গায়ব"। অনুবাদ : 'মাটির পর্দা সরিয়ে রুহের সৌন্দর্য অবলোকন করো তবে সেখানে খোদার নুর ও অদৃশ্য জগতের রহস্য দেখবে।'
আল্লাহর প্রতি ব্যক্তির সম্পর্ক সুদৃঢ় করণে মাইজভান্ডারীয়া তরিকার প্রবর্তক গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) বলেন," কিয়া আজ জুমা কা দিন নেহী হ্যায়? তোম লোগ অজু কর কে মসজিদ মে চালে যাও। নামাজ পড়হো আওর আল্লাহ আল্লাহ কর কে আপনে আপনে ঠিকানে পে চালে যাও।' তিনি আরো বলেন, 'কুনজাসকির মত আপন হুজরায় বসে সর্বদা খোদার জিকির কর।' গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)'র প্রথম ও প্রধান খলিফা কুতুবুল আকতাব হজরত মাওলানা অছিয়র রহমান ফারুকী চরণদ্বীপি (কঃ) বলেন,
"মিঞা! তুমি তো ইল্লাল্লাহের মজনুন। তোমার পথ সোজা আছে, কিন্তু পথের মধ্যখানে গওহারজান কালফণী স্বরূপ ফণা বিস্তার করিয়া গমনে বাঁধা দিতেছে। আচ্ছা! আমিও তাহার নিকট যাওয়ার পথ বন্ধ করিয়া দিব। তাহার পথে কালভুজঙ্গ পাহাড়াদার পাঠাইয়া দিব। তাহা হইলে তুমি ইল্লাল্লাহের প্রেম বাজারে পৌঁছিবে।"
দুই. স্বীয় অস্তিত্বের প্রতি সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ: রূহ ও দেহের সমন্বয়ে মানব জীবন গঠিত। পৃথিবীতে মাতৃগর্ভে দেহের অস্তিত্বের পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা আলমে আরওয়াহ'য় (রুহের জগত) রূহ সৃজন করে রেখেছেন। রূহ ব্যতিরেকে মানব শরীর মূল্যহীন মৃতবৎ জড় পদার্থ সদৃশ। রূহ শরীরে অবস্থানকালীন সময় হলো জীবন আর শরীর হতে রূহ প্রস্থান হলো মৃত্যু। সুতরাং সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে, রূহ হলো মানব জীবনের নিয়ন্ত্রক আর রূহের নিয়ন্ত্রক হলেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা। তাই আদর্শ ও আলোকিত মানব গঠনে স্বীয় অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু রূহের স্বরূপ অনুধাবন পূর্বক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ অত্যাবশ্যক। শারীরিক কারণে মানব পৃথিবীতে অবস্থান করলেও রূহগতভাবে সে সারা বিশ্বে পরিভ্রমণ করে থাকে। এমনকি ব্যক্তির নিদ্রাকালীন সময়ে আরশের সন্নিকটে আল্লাহ তায়ালাকে সিজদা প্রদানের সুযোগ লাভে ধন্য হয়। যেমন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, ঘুমান্ত অবস্থায় রূহ আসমানের দিকে পরিভ্রমন করে, আরশের নিকটে সিজদা প্রদানের আদিষ্ট হয়। যদি পবিত্র আত্না বিশিষ্ট হয় তাহলে আরশের সন্নিকটে সিজদা প্রদান করে। আর অপবিত্র আত্মা বিশিষ্ট হলে আরশের দূরবর্তী স্থানে সিজদা করে। (শুয়াবুল ইমান কৃত ইমাম বায়হাকী)। মানব শরীরের দুইটি দিক রয়েছে। একটি বাহ্যিক দিক আর অপরটি আভ্যন্তরীণ দিক। আল্লাহ তায়ালা মানব শরীরের বহিরাংশে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে বাহ্যিক আকৃতি ও অবয়বতা প্রদান করেছেন আর তা বাহ্যিক দিক তথা জাহেরী দিক। অপরদিকে মানব শরীরের সঞ্চালন ও জীবন ধারণের নিমিত্তে দেহের অভ্যন্তরে রূহের সঞ্চার ঘটিয়েছেন আর তা হলে আভ্যন্তরীণ দিক তথা বাতেনী ও রূহানিয়ত দিক। মানুষ বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত এবং বাহ্যিত সৌন্দর্য রক্ষায় সদা তৎপর কিন্তু আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য তথা রূহানিয়ত সম্পর্কে গাফেল। অথচ ইমান, ইসলাম, ইহসান, বেলায়ত ও মারেফতের নুরে আলোকিত হতে স্বীয় রূহের সাথে প্রেমাষ্পদ আল্লাহর তায়ালার সম্পর্কে সুদৃঢ়করণে তথা রূহানিয়তের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অত্যাবশ্যক। সেজন্য চিশতীয়া তরিকার শাইখ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরী (রঃ) বলেন, 'জামালে শাহেদে জান বীঁ ওয়ারায়ি পর্দায়ে চাক, চুনাঁ কে নুরে খোদা আজ ওরায়ী আলেমে গায়ব' । অর্থ : মাটির পর্দা সরিয়ে রুহের সৌন্দর্য অবলোকন করো, তবে সেখানে খোদার নুর ও অদৃশ্য জগতের রহস্য দেখবে। তাই আদর্শ ও আলোকিত মানব গঠনে স্বীয় অস্তিত্বের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতঃ রূহানিয়তকে উদ্ভাসিত ও মনের পরিচর্যায় প্রতি গুরুত্বারোপ করে মাইজভান্ডারীয়া তরিকার প্রবর্তক গাউসুল আজম হজরত শাহসুফী সাইয়্যিদ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) বলেন, 'ফেরেস্তার কালেব বনে যাও'। তিনি আরো বলেন, 'সংযম সাধনায় মনের উজ্জ্বলতাকে পরিচর্যা ও উদ্দীপ্ত করে।'
তিন. স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী : ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর সব সৃষ্টি মানবের কল্যাণার্থে সৃজিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (মানুষের) জন্য সৃষ্টি করেছেন। (সুরা বাকারা, আয়াত নং ২৯)। আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (দঃ) ইরশাদ করেন, সব সৃষ্টি আল্লাহ পরিবার। সুতরাং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় সেই মাখলুক যে তার পরিবারবর্গের জন্য বেশি উপকারী।" (আল মুজামুল কাবির কৃত আল্লামা তাবরানী)। আদর্শ ও আলোকিত মানবে পরিণত হতে আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী অপরিহার্য। কেননা আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টি তাঁরই কুদরতের বহিঃপ্রকাশের চিহ্নস্বরপ। তাই তো পবিত্র কোরআন কারীমে আল্লাহ তায়ালার অমোঘ বাণী বিঘোষিত ' যে কেউ ইচ্ছা করে কোন মুমিনকে হত্যা করে তাহলে তার শাস্তি জাহান্নাম।' (সুরা নিসা, আয়াত নং ৫৩)। কেবল মুসলিম নয়, অমুসলিমদের প্রতি কিরূপ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতে হয় তা পবিত্র হাদীস শরীফ দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর রাসুল (দঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে ব্যক্তি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়। (সহীহ বোখারী, অধ্যায় : রক্তপণ)। কেবল মানব নয়, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টির প্রতি প্রদর্শিত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর রূপরেখা পরিলক্ষিত হয় প্রিয়নবী (দঃ)'র মুখ নিঃসৃত পবিত বাণীসমূহে। হযরত রাসুলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করেন, এক ব্যক্তি কোন পথ ধরে চলছিল, এমতাবস্থায় তার খুব পিপাসা পেল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নেমে পড়ল এবং পানি পান করল। এরপর সে বেরিয়ে এল। তখন সে দেখতে পেল যে, একটি কুকুর (পিপাসায়) জিব বের করে হাঁপাচ্ছে আর মাটি চাটছে। লোকটি (মনে মনে) বলল, কুকুরটির আমার মত তীব্র পিপাসা পেয়েছে। তখন সে কুয়ায় নামল এবং তার (চামড়ার) মোজায় পানি ভরল পরে সে তার মুখ আটকে ধরে উপরে উঠল এবং কুকুরটিকে পান করালো, মহান আল্লাহ তার (এ আমলের) কদর করলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। (সাহাবীগণ) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তা হলে কি আমাদের জন্য এসব প্রাণীর ব্যাপারে (সদাচরণে)–ও সাওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন, প্রতিটি তাজা কলিজায় (প্রানধারীতে) সাওয়াব রয়েছে।' (সহীহ বুখারী, অধ্যায় : পানিসেচ)। তাই তো আদর্শ ও আলোকিত মানব গঠনে আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ধারণে কোরআনের নির্দেশনা ও নবীজী (দঃ)'র আদর্শের আলোকে মাইজভান্ডারীয়া তরিকা দীক্ষা দিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। ফলে মাইজভান্ডার দরবার শরীফে পরিলক্ষিত হয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি।