শনিবার - ২১শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২৫শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

১৩ প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি সোনালী ব্যাংক

দেশের ১৩ প্রতিষ্ঠানের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির মোট ঋণের প্রায় ৩৫ শতাংশ তুলে নিয়েছে। এদের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে ঋণের দায় শোধ করছে না, তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানও সমানভাবে বড় অঙ্কের ঋণের টাকা আটকে রেখে সোনালী ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই ১৩ গ্রাহকের কাছে আটকে আছে সোনালী ব্যাংকের ২৯ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকার ঋণ। তালিকায় বহুল আলোচিত হল-মার্ক ও থার্মেক্স গ্রুপ যেমন আছে, তেমনি আছে বেসরকারি খাতের টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপ ও ব্র্যাক। এ ছাড়া আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান খাদ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফ), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড, বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এসব প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছে। কেলেঙ্কারি আর অনিয়মের মাধ্যমে নেওয়া বড় অঙ্কের ঋণ ফেরত পাওয়া যাবে, সে আশাও ক্ষীণ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের শীর্ষ সরকারি সোনালী ব্যাংক বড়দের ঋণ দিয়ে এখন অনেকটাই বিপর্যয়ের মুখে। এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঠিকমতো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। যার ফলে বড় অঙ্কের ঋণ অনাদায়ি হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকটির গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৭৯৭ কাটি টাকা। তার মধ্যে মাত্র ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২৯ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণের ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
তার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪৭২ কোটি ৫৩ লাখ ৫৪ হাজার। ঋণের অবশিষ্ট অর্থ ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ ছাড়ে ও নানা কৌশলে পুনঃতফসিল করা হয়েছে, যা মূলত ব্যাংকের খাতায় অনাদায়ি অর্থ। সোনালী ব্যাংকে পুনঃতফসিলের সময় যে এককালীন পাওনা পরিশোধের কথা সেটিও আদায় হয়নি বলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর সাধারণত বড় গ্রাহককে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহ দেখায়। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এতে একজন গ্রাহক দেউলিয়া হলে খেলাপি বেড়ে যায়, যা ব্যাংকের জন্য বাড়তি ঝুঁকি সৃষ্টি করে। আবার গুটিকয়েক কয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে ঋণ দিলে দেশের ভালো উদ্যোক্তারা ঋণ পান না। এটি অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৭১৩ কোটি ২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ২ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। থার্মেক্স গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮২ কোটি ৩২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট ঋণের স্থিতির ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। টি অ্যান্ড ব্রাদার্স গ্রুপের কাছে সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪৯০ কোটি ২৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৩৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে ৪ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৩ লাখ, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ৮৪৫ কোটি ৭৩ লাখ, সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের কাছে ৪৯৫ কোটি ৮২ লাখ, ব্র্যাকের কাছে ৫৯৭ কোটি ৭২ লাখ, বিসিআইসির কাছে ৩ হাজার ৬১৮ কোটি ৮৪ লাখ, বিএডিসির কাছে ৯ হাজার ২৫ কোটি ৮৭ লাখ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকটির।
বিএসএফআইসির কাছে সোনালী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৫০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া টিসিবির কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ঋণ শোধে পিছিয়ে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান বলেন, ‘আমরা পণ্য কেনার সময় সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে অর্থ নিয়েছি। পণ্য বিক্রি করে এবং সরকারের ভর্তুকির টাকা পাওয়ার পরে তা ব্যাংকে পরিশোধ করি। এ ক্ষেত্রে ঋণ হিসাবে বকেয়া রয়েছে। এটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরিশোধ করা হয়।
এসব ঋণের একটি অংশ বিতরণকালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার চেয়ে ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই খুবই জরুরি। কোনো ত্রুটি থাকলে তা আদায় করা কঠিন। উদাহরণ হিসেবে হল-মার্কের ঋণ কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ঋণ আদায়ে কোনো পদক্ষেপ আলোর মুখ দেখে না। তবে আদায়ে নানা উদ্যোগ সব সময় ছিল, এখনো রয়েছে।’
এসব ঋণের বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি আফজাল করিম বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক ঋণ বিতরণ ও আদায়ে নিজস্ব নীতিমালা অনুসরণ করে। তবে বড় গ্রুপ ও সরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ আদায় করার জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ে নানা দিক বিবেচনায় নিতে হয়। আমাদের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। আইএমএফের শর্তের তুলনায় অনেক বেশি হলেও খেলাপি কমাতে বিশেষ চুক্তি করা হয়েছে। আশা করা যায়, সামনে হল-মার্কসহ অন্যান্য ঋণ আদায়ে দৃশ্যমান উন্নতি হবে।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn