বুধবার - ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২২শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

সেনাবাহিনীর পুলিশ-র‍্যাব যৌথ অভিযানে কক্সবাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহীন আটক

সেনাবাহিনীর পুলিশ-র‍্যাব যৌথ অভিযানে কক্সবাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহীন আটক

 

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের কক্সবাজার রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে শাহীন ডাকাত। নিজের নিয়ন্ত্রণে মাদক পাচার, খুন, ডাকাতি, অবৈধ গরু পাচারসহ সকল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শাহীন সীমান্তজুড়ে ব্যবহার কর‍তেন সিসিটিভি ক্যামেরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে গেলে নিজের সোর্স ও এসব ক্যামেরায় সতর্ক বার্তা পেয়ে পালিয়ে যেতেন।

হত্যা অস্ত্র মাদক ও চোরাকারবারসহ প্রায় ২০ মামলার আসামী এই শাহীনকে আটকের পর এমন তথ্য দিয়েছে সেনাবাহিনীসহ অপরাপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এমনকি মুখ খুলছেন আলোচিত ওই গর্জনিয়া এলাকার বাসিন্দারাও।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের জাউচপাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। শক্ত সীমানাপ্রাচীর নির্মিত একটি বাসা থেকে আলোচিত এই ডাকাত শাহীনুর রহমানকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর একটি দল।

সেনাবাহিনী বলছে, ইতিমধ্যে সিসিটিভিসহ যে সমস্ত টেকনিক্যাল সরঞ্জাম রয়েছে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে এবং ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ইতিপূর্বে যে অভিযানগুলো হয়েছিল সেগুলোতে আমরা সিসিটিভি খুলে নিয়েছিলাম। এখনও যেসব ক্যামেরাগুলো আছে সেগুলো র‍্যাব ও বিজিবির সহায়তায় খুলে নিয়ে যাবে।

গণমাধ্যমের কাছে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায় গ্রেফতারের পর শাহীন পালানোর চেষ্টা করছিলেন তখন সেনা সদস্যরা তাকে আঘাত করে সামলাতেও দেখা গেছে।

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা রামু সেনা নিবাসের লে. কর্ণেল মনুয়ার রামু বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শাকের মেম্বারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে শাহীনকে আটক করা হয়েছে। পরে তার ডেরা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক, জাল টাকা ও ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়।

সেনা কর্মকর্তা মনুয়ার বলেন, গত ২৫ মে র‍্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ টহল দল সন্ত্রাসী শাহীনকে গ্রেফতার করার জন্য অভিযানে নামলেও শাহীনের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে শাহীন ডাকাত ত্রাস সৃষ্টি করতে চেয়েছিল জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, গর্জনিয়া নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় গরু ও মাদক চোরাচালান এবং আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির ঘটনা ঘটে। যা জনমনে আতঙ্ক ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে।

শাহীন ডাকাত এতোটাই ভয়ংকর ও দাপুটে ছিলো যে তাকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা দল কর্তৃক দীর্ঘদিন গোয়েন্দা নজরদারি করতে হয়েছে।

সেনাবাহিনী টহল দল কৌশলে সন্ত্রাসী শাহীনকে গ্রেপ্তার করে জানিয়ে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দশ পদাতিক ডিভিশনের ৪ টি টহল দল কর্তৃক সমন্বিতভাবে একযোগে ৪ টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে একটি ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হয়। এক পর্যায়ে শাহীনকে শাকের মেম্বারের বাড়ি থেকে আটক হয়।

সন্ত্রাসী শাহীনকে গ্রেফতার করার পর রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় শাকের মেম্বারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১০ টির বেশি দেশীয় ধারালো অস্ত্র, ৩ টি এক নলা বন্দুক, ১ টি এ.কে 22, ১০ রাউন্ড গুলি, ৪ টি বন্দুকের কার্তুজ, ২০ হাজার ইয়াবাসহ জাল পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, শাহীন ও তার বাহিনী সীমান্ত দিয়ে আসা গরু এবং চোরাচালান পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ করত।

প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার গরু থেকে ৩ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করত তারা। ইয়াবা, আইস, বিদেশি সিগারেটসহ চোরাচালান পণ্যের করিডোরও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শাহীনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল জানান স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি।

স্থানীয়দের ভাষ্য, সেখানে আইন নয়, চলত শাহীনের আদেশ।

তার অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো কাজ করতে পারত না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহীন বহু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। গরু ও মাদক পাচারে কেউ বাধা দিলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। ২০২৩ সালের ৩ মার্চ ইরফান এবং ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ আবু তালেব ও ৮ মে আবুল কাশেমকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তাই সন্ত্রাসী শাহীনকে গ্রেফতারের মাধ্যমে গর্জনিয়া নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার মানুষের মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে।

এর আগে ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের মেঘলা এলাকা থেকে সন্ত্রাসী শাহীনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ জানিয়েছে, শাহীনের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ডাকাতি, ৪টি হত্যা, ২টি অস্ত্র, ২টি মাদক এবং আরও কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি বিভিন্ন থানায় করা হয়েছে।

শাহীনের সাথে তার দুইজন সহযোগীও গ্রেফতার হয়েছে। তবে তার অন্যান্য সহযোগীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে সেনা কর্মকর্তা মনোয়ার বলেন, “যেসব সহযোগী এখনো গ্রেফতার হয়নি ক্লিয়ার ম্যাসেজ টু দেম, সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

সীমান্তের ১১ বিজিবর অধিনায়ক লে: কর্ণেল কফিল উদ্দিন বলেন, সীমান্ত থেকে শাহীনের যে চক্র ছিল এবং এই চক্রের সাথে যারা জড়িত ছিল সকলকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের অভিযান চলমান থাকবে। স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতা কাম্য। শাহীনের যে সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো আছে সেগুলো আগের অভিযানে রেখে দেওয়া হয়েছিলো যাতে আমাদের পরবর্তী অভিযানে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তবে এখন তাকে গ্রেফতারের পর প্রশাসনের সহযোগিতায় সিসিটিভি ক্যামেরাসহ তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করণের বিষয়ে কাজ করা হবে।

র‍্যাব ১৫ এর লে. কর্ণেল কামরুল হাসান বলেন, তিন মাস আগে এই এলাকায় আমাদের এক্টিভিটি কম ছিল। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দিনরাত যৌথ টহলের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে কোরবানির ঈদের আগেও চোরাই পথে যাতে গরু, মাদক কিছুই না আসতে পারে এইজন্য র‍্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী অভিযান চালায় এবং এই অভিযানে তারা সফলও হয়।

গত বছরের সময়ের সাথে তুলনা করলে এবছর গরু চোরাচালান, মাদক চোরাচালান উদ্বেগজনক হারে কমেছে জানিয়ে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, গত সপ্তাহেও বিপুল পরিমাণে মাদক জব্দ করা হয়েছে। ৩/৪ দিন আগে ৪১ টির মতো গরু আটক করা হয়েছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn