বুধবার - ২৫শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ১১ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২৯শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

সুন্দরবন সংলগ্ন বাঘ বিধবা পারভীন বিবির ঘর-সংসার

সুন্দরবন সংলগ্ন বাঘ বিধবা পারভীন বিবির ঘর-সংসার

সুন্দরবনবর্তী উপকূলীয় মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে একমাত্র সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া, মধু সংগ্রহ করে। এসব এলাকার মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে থাকে।

২০২০ সালের জরিপে দেখা গেছে সাতক্ষীরা উপকূলজুড়ে সুন্দরবন এলাকায় ১হাজারের বেশি বাঘ বিধবা রয়েছে। এদের মধ্যে এমন পরিবার রয়েছে বাবা বাঘের হাতে মৃত্যু হয়েছে। পরবর্তীতে সুন্দরবনের যেয়ে বাঘের হাতে ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে। পরবর্তীতে দেখা যায় এই পরিবারটির সাংসারিক হাল ধরার মত কেউ রইল না।

এসময় জীবন বাঁচানোর তাগিদে মা বৌমাকে (ছেলের স্ত্রী) নদীতে জাল মাছ শিকার করে সংসার চালাতে হয়েছে। এমন ও বাঘ বিধবা আছে ছেলে বড় হয়েছে মাকে ভাত দিচ্ছেনা। তাদেরকে অনেক কষ্ট করে জীবন বাঁচাতে হয়েছে।

সাতক্ষীরা শ্যামনগর বুড়িগোয়ালিনী এলাকার চন্ডিপুর গ্রামের জবেদ গাজীর ছেলে মৃত জিয়ারুল গাজী সুন্দরবনে মাছ ধরতে যায় ২০০৮ সালে। ২ ভাই মুন্সিগঞ্জ বনবিভাগের অফিস থেকে পাস নিয়ে এক রবিবার সকালে সুন্দরবনের তেরকাটি খাল এলাকায়। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঝপ করে শব্দ শুনতে পান। পাশে থাকা ভাই আনারুল ইসলাম। তিনি দেখতে পায় ভাই জিয়ারুলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে হিং¯্র বাঘে।

আনারুলের হাকাহাকিতে কর্ণপাত করলো না সুন্দরবনের হিং¯্র বাঘ।
ভাই আনারুল বলেন আমি দাড়িয়ে থেকে দেখলাম আমার ভাই জিয়ারুলের গলায় বাঘে দাঁত বসিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেসময় নিথর পাথরের মতো দাড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না আমার।
নৌকা ছেড়ে বাড়ি ফিরে খবর দেই ভাই জিয়ারুলকে বাঘে নিয়ে গেছে। তখনই খবর হয়ে গেল জিয়ারুল বনে পড়েছে। আর সেই থেকে জিয়ারুল গাজীর স্ত্রী পারভীন হয়ে গেলেন বাঘ বিধবা।

২ সন্তান নিয়ে শুরু হলো জীবন সংগ্রাম পারভীনের।
জীবনের ১৭টি বছর একাকি পার করে আজ বিধবা পারভীন ৩৮বছর বয়সে নদীতে মাছ ধরে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালানোসহ ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিক্ষানো ও বাচ্চা দুই টিকে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। পারভীনের ছেলের বয়সএখন ২০ বছর।

শুক্রবার (৯ মে) সকালে সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, বাঘ বিধবা পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন।
বাঘ বিধবা পারভীনের জীবন কাহিনী শুনতে চাইলে তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার জীবনের কথা বলে দুঃখ বাড়াতে চাই না। পারভীন বলেন খুব ছোটকালে বৌ হয়ে গিয়েছিলাম ওই বাড়িতে, আজ শুনতে হয় আমি বাঘ বিধবা। পারভীন এখন বাবার বাড়িতে জীবন জাপন করছে বাচ্চা দুই টারে নিয়ে। পারভীনের বাবাও বুড়া মানুষ তিনি নিজেই কর্মকরে খেতে পারেন না তার উপরে আবার এই বিধবা মেয়ের বুঝা কিকরে টানবেন।

সুন্দরবন নির্ভরশীল বাঘ বিধবারা এরা সাথী হারা বাঘ বিধবা। উপকূলীয় অঞ্চলে কর্মসংস্থান সঙ্কটের কারণে পরিবারের একমাত্র উপার্জণক্ষম ব্যক্তি বিকল্প পেশা হিসেবে সুন্দরবনের পেশায় যুক্ত হয়। সে কারণে নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে নোনা পানির চিংড়ি চাষের কারনে মানুষের কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। মানুষ বিকল্প পেশা হিসেবে সুন্দরবনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফলে বাঘের আক্রমনের শিকার হতে থাকে।

সামাজিক কুসংস্কার এর ধুমজাল ছুটে বেড়াতে থাকে এরা নাকি অপায়া অলক্ষী স্বামী খেগো। বাঘ বিধবারা অধিকাংশ স্বামীর ভিটা ছেড়ে বাপের বাড়ি অথবা খাস জায়গাতে তাদের শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের রক্তচক্ষু ঘৃণা অবহেলায় সন্তানদের সুশিক্ষায় গড়ে তোলার সুযোগটুকু হয়ে ওঠেনি, এই দুঃসময়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় আইলা, বুলবুল ফণি আমফান এই সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের হাল ছাড়েনি।

জীবন সংগ্রামে অনেকেরই তছনছ করে দিয়েছে ছোট্ট কুঁড়ে ঘর টুকু তবুও বেঁচে থাকার স্বপ্ন স্বামীর পথ ধরে বাঘ বিধবারা। আজও সুন্দরবনের পেশার সাথে জড়িত আছেন এ কষ্টের অনুভূতি টুকু প্রকাশ করতে গিয়ে বাঘ বিধবারা স্বামী কথা মনে করতেই হু হু করে কেঁদে উঠেন। এমনও বাঘবিধবা পরিবার রয়েছে অন্যের সহযোগিতায় সংসার চালাতে হয় তাদের।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn