
সুখের সংজ্ঞা কি
শাহিদা আকতার জাহান
ভূমিকা
সুখ—একটি ক্ষণস্থায়ী অনুভব, আবার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা। মানুষ জন্মগ্রহণের পর থেকেই সুখের সন্ধানে পথচলা শুরু করে। কেউ খোঁজে অর্থে, কেউ খোঁজে ভালোবাসায়, কেউবা আবার আত্মিক শান্তিতে। কিন্তু সুখ কি আদৌ ধরা দেয়? নাকি এটি শুধুই এক মানসিক প্রতিচ্ছবি, যার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু মুঠোবন্দি করা যায় না? সুখ, দুঃখ, আনন্দ ও বেদনা—সব মিলিয়ে মানুষের জীবন এক অদ্ভুত যাত্রা। এগুলো যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ—
সুখের দর্শন ও বহুমাত্রিকতা
সুখ একটি বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক ও জৈবিক অনুভূতির নাম। এটি কোনো বস্তু নয়, বরং ব্যক্তি ও প্রসঙ্গভেদে ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। সুখকে একক সংজ্ঞায় বাঁধা অসম্ভব। একজন কৃষকের কাছে হয়তো দিনের শেষে পরিবারের সঙ্গে এক থালা ভাতই সুখ, আবার একজন শিল্পপতির কাছে তা হয় কোটি টাকার প্রকল্পের সাফল্য কিংবা মহান আল্লাহ প্রতি অনুগত বিশ্বাস। তাই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সুখের ব্যাখ্যাও বিভিন্নভাবে উঠে আসে। মানুষ প্রতিনিয়ত সুখের পেছনে দৌড়ায়, কিন্তু অনেকেই জানে না যে, স্থায়ী সুখের চেয়ে অন্তরের শান্তিই অধিক মূল্যবান। অতএব, সুখ একদিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অন্যদিকে সমাজ ও সংস্কৃতি-নির্ভর।
আধুনিক সমাজে সুখের বিভ্রান্তি
বিশ্বায়নের যুগে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সুখের প্রকৃত ধারণাকে ভ্রান্ত করেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম অনেক সময় বাহ্যিক চাকচিক্যকে সুখ মনে করে, অথচ প্রকৃত সুখ নিহিত রয়েছে মানসিক প্রশান্তিতে। সামাজিক মাধ্যম, প্রযুক্তি ও উদার অর্থনীতির হাত ধরে আমরা এমন এক সমাজ গড়েছি, যেখানে ‘ভোগই সুখ’—এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এক নির্জন রাতে, একাকী এক চায়ের কাপ কিংবা মায়ের স্নেহস্পর্শও হতে পারে গভীরতম সুখের উৎস।
সুখের উপাদান ও মূল্যবোধ
সুখ অর্জনের জন্য কিছু মৌলিক উপাদান প্রয়োজন: সুস্বাস্থ্য, পারিবারিক বন্ধন, আত্মিক প্রশান্তি, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা ও মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয়মূল্যবোধ। এ উপাদানগুলো যুগে যুগে মহান মানবরা তাদের জীবনদর্শনে গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মগ্রন্থগুলোতেও আত্মিক উন্নতি ও নৈতিকতা—সুখের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।
বিশ্বাসযোগ্যতা, আত্মনির্ভরতা এবং ঈশ্বর বা প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা—এই তিনটি উপাদান জীবনকে সুখের পথে পরিচালিত করে। ইসলাম ধর্ম মতে, একজন মুমিন তখনই সত্যিকারের সুখী হয়, যখন সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে, কৃতজ্ঞ হৃদয়ে জীবন যাপন করে। এই জীবনের সময়সীমা ক্ষণিক, তাই আধ্যাত্মিক শান্তি ছাড়া সুখের স্থায়িত্ব নেই।
সমাজের নিম্নস্তরে সুখের স্বরূপ
বিচিত্র এক বাস্তবতার মুখোমুখি হই প্রতিদিন। যাদের কিছুই নেই, তারাই যেন সুখে বেশি! দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানওয়ালারা—যাদের জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ, তারাই সারাদিনের শেষে ডাল-ভাত খেয়ে গভীর ঘুমে তৃপ্তি পায়। ওষুধবিহীন ঘুম, ঋণবিহীন মন—এই দুটো বিষয় তাদের কাছে সুখের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। অপরদিকে, বহু বিত্তশালী মানুষ প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেয়েও অনিদ্রায় ভোগে। তারা বাহ্যিক ভোগে ডুবে থাকলেও হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ করতে পারে না।
শেষ কথা
সুখ একটি অন্তর্জাগতিক উপলব্ধি, যা কেবল বাহ্যিক অর্জনে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আত্মার প্রশান্তি, মননের পরিতৃপ্তি, এবং বিশ্বাস ও নৈতিকতার সম্মিলনে জন্ম নেয়। সুখের খোঁজে আমাদের যতই বাইরে ছুটতে ইচ্ছে করুক না কেন, একদিন উপলব্ধি করতে হবে—সুখ আসলে আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল। প্রয়োজন কেবল সেটিকে আবিষ্কারের আন্তরিক প্রচেষ্টা। সুখ আমাদের বাইরে নয়, বরং অনেকদিন ধরেই আমাদের ভেতরেই ছিল।