
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের পাঁচতলা নতুন ভবনে শ্রমিকদের পাওনা ১৭ লাখ টাকা
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের পাঁচতলা নতুন ভবনে শ্রমিকদের পাওনা ১৭ লাখ টাকা। অধ্যক্ষ বললেন ভবন অবৈধ, তাই টাকা দিতে পারবেন না।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের পাঁচতলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন-২-এ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে এখনো শ্রমিকদের পাওনা ১৭ লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করেননি কলেজ কতৃপক্ষ। বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল হাশেম ওই পাওনা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানিয়ে দাবি করেছেন, “ভবনটি অবৈধ, তাই আগের কোনো কাজের বিল দেওয়া সম্ভব নয়। তবে, সেই “অবৈধ” ভবনেই পূর্বের শ্রমিকদের টাকা না দিয়ে নতুন শ্রমিকদের কাজে লাগিয়েছেন তিনি। ফলে তীব্র অসন্তোষের মুখে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যে ভবনকে ‘অবৈধ’ বলা হচ্ছে, সেখানে বর্তমানে কিভাবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বরাদ্দে নির্মাণকাজ চলছে?
স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন ও শিক্ষকদের একাংশ বলছেন-এই ভবনে আগেও কাজ হয়েছে, বরাদ্দ এসেছে এবং কাজের সুনির্দিষ্ট হিসাব কলেজের কাছেই রয়েছে। এখন ‘অবৈধ’ বলে দাবি করাটা শ্রমিকের পাওনা অস্বীকারের একটি অজুহাতমাত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর আফজাল হোসেন ও ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর মো. আমানউল্লাহ আল হাদীর নির্দেশে নির্মাণ শ্রমিক ওবায়দুল ইসলাম কলেজের নতুন প্রশাসনিক ভবন-২ ও মহিলা কমন রুম নির্মাণের কাজ শুরু করেন। চুক্তি অনুযায়ী, কলাম স্ট্রাকচারের জন্য প্রতি স্কয়ারফুটে ২০০ টাকা এবং ইটের গাঁথনির জন্য ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
নির্মাণ শ্রমিক ওবায়দুল ইসলাম জানান, ভবনের কাজ ৩৫ হাজার স্কয়ারফুট হয়েছে, যার মোট বিল দাঁড়ায় ৭০ লক্ষ টাকা। এ পর্যন্ত তিনি পেয়েছেন প্রায় ৪৩ লক্ষ টাকা। তার পাওনা ২৭ লক্ষ টাকা। তবে, ইতোপূর্বে আপোষ-রফায় তিনি ১০ লাখ টাকা ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও তার ১৭ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আব্দুল হাশেম বলেন, আমি ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে যোগদান করি। আমার কাছে ভবনটির অনুমোদন সংক্রান্ত কোন নথি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আগের কোনো বিল্ডিংয়ের বরাদ্দ বা ব্যয়ের হিসাব আমার জানা নেই। তাই আমি আগের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারবো না।
তিনি ভবনটিকে “সরকারি অনুমোদনবিহীন” বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, আগের কাজের দায়িত্ব তার নয়।
অধ্যক্ষ যেখানে ভবনকে অবৈধ বলছেন, সেখানে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে-এই একই ভবনে এখনো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে সরকারি বরাদ্দে কাজ চলমান রয়েছে। সাতক্ষীরা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী কিংকন বিশ্বাস জানান, প্রশাসনিক ভবন-২-এর অবশিষ্ট কাজের জন্য কলেজের পক্ষ থেকে আবেদন এলে আমরা তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কয়েকবার এ ভবনের জন্য অল্প অল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমানউল্লাহ আল হাদী বলেন, ওবায়দুল ইসলাম নির্মাণ কাজ করেছেন, মেপে হিসাব করা হয়েছে। শিক্ষকদের মাধ্যমে ভবনে কাজের পরিমাণ যাচাই করে হিসাব করা হয়, যার ভিত্তিতে ২৬-২৭ লক্ষ টাকা পাওনার হিসাব উঠে আসে। আপোষ-রফায় ওবায়দুর ইসলাম নিজে ১০ লক্ষ টাকা ছেড়ে দিয়ে বাকিটা চেয়েছেন। ভাইস প্রিন্সিপালের কাছে হিসাবের মূল কপি সংরক্ষিত রয়েছে।
অর্থনীতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের তিনজন শিক্ষক মিলে ভবনের মাপ ও হিসাব নিরূপণ করেন। তাদের দেওয়া হিসাবে, ওবায়দুল ইসলামের প্রাপ্য ১৭ লক্ষ টাকা।
কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহিনুর রহমান বলেন, ওবায়দুল ইসলাম যে এখনো টাকা পাননি, এটা আমরা সবাই জানি। আগের প্রিন্সিপাল স্যারের দায়িত্বে ফান্ড কালেকশন করে কাজ করানো হয়েছে। সম্পূর্ণ বিল দেওয়া হয়নি-এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।
সাতক্ষীরা জেলা ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সিকদার বলেন, ওবায়দুল ইসলাম আমাদের ইউনিয়নের সদস্য। তার পাওনা টাকা পরিশোধ না করে অন্য মিস্ত্রি দিয়ে কাজ শুরু করে বর্তমান অধ্যক্ষ হাশেম স্যার, এটাতো অন্যায়। যতদিন পর্যন্ত তার পাওনা মেটানো না হবে, আমরা কলেজে কোনো শ্রমিক পাঠাবো না। প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নিজ ঘাম ও পরিশ্রমের সঠিক মূল্য না পেয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ ওবায়দুল ইসলাম বলেন, আমি এখনো আমার ন্যায্য পাওনার অপেক্ষায় আছি। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা ও পরিবার-পরিজনের দায় মেটাতে এখন চরম সংকটে আছি। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহানুভূতির দৃষ্টি কামনা করছি।
এদিকে ভবনটিকে “অবৈধ” ঘোষণা করেও সেখানে বরাদ্দের অর্থে কাজ চলমান রেখে শ্রমিককে তার প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।