শুক্রবার - ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ১লা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৫ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

সফল মানুষের পরাজয়ের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

সফল মানুষের পরাজয়ের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

সুখের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে সুখি হতে চেষ্টা করে বহু মানুষ সুখি হতে পারে না। সুখি হওয়া ব্যতিক্রম বিষয়। সুখের জন্য অঢেল সম্পদ উপার্জন করে ৯৯ ভাগ মানুষ সুখি হতে পারে না। গরীবরা ভাবে ধনীরা সুখি। টাকার অভাবে তারা মানুষ সুখি হতে পারে না। প্রেম করে সুখের জন্য। বিয়ের পর প্রেমিকাকে সুখি করতে পারেনা। প্রেমের বিয়েতে বিচ্ছেদই বেশী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এরা সুখের লাগি চাহি প্রেম, প্রেম মিলে না,/ শুধু সুখ চাল যায়। /এমনি মায়ার ছলনা।/ এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়,। লায়লী-মজনু, শিরী-ফরহাদ, দেবদাস-পার্বতী, চণ্ডিদাস-রজকিনি তারা প্রেম করার পর যদি বিয়ে হতো তাহলে ১০দিনের মধ্যে ঝগড়া লাগতো। কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল। বিচ্ছেদে কবি হয়,সাহিত্যিক হয়,পাগল হয়, আত্মহত্যা করে, মিলনে শুধু সন্তান জন্ম হয়। এক সময় ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব হতো না, প্রেম হতো, এখন সেই যুগ আর নেই, ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রেম, বন্ধুত্ব, মিলন সবই হয়। বিয়ে হয়, আবার সেই বিয়ে সহজে ভাঙনও হয়। এসব বাড়ছে, শুধু কমছে সুখ।
অনেক মেধাবী মানুষ সংগ্রাম করে বড় হয়ে সুখি হতে চেয়েছেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তারা সুখি হতে পারেননি। সফল মানুষের পরাজয়ে মিছিল দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রহমান ছিলেন জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তার চলমান পাঠশালায়র রয়েছে হাজার হাজার ছাত্র। যার লেখা ও গবেষণা প্রচুর বাঙালিকে মুগ্ধ করতেন। তার মত কম মানুষই সফল হয়। এই মানুষটির মেয়ে-স্ত্রী থাকতেন আমেরিকায়। তিনি থাকতেন উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটে। একা নিঃসঙ্গ জীবন তার আনন্দের ছিল না। এক রাতে তিনি হঠাৎ মারা যান। কেউ জানে না তার মৃত্যুর সংবাদ। পুলিশ তিনদিন পর তার পঁচা লাশ দাফন করে। তার খ্যাতি ছিল, পরিচিতি ছিল, আত্মীয় স্বজন কম ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর সময় কেউ পাশে ছিল না। এই হলো একজন সফল মানুষের জীবন।
আরেক চিকিৎসক ঢাকায় বন্ধ ঘরে মারা গেল। দেশে পরিবারের কেউ থাকে না। লাশ পচে রইল ঘরে। পুলিশই গলিত লাশ উদ্ধার করে। ধানমণ্ডিতে মৃত্যু বরণ করলো আরেক ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি। তার সন্তানরা সবাই থাকে বিদেশে। লাশ দাফনের কেউ ছিল না। কাফন দাফন করলো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।
আরেক ব্যক্তির জীবনে সবকিছুই ছিল। কিন্তু আপনজনদের অপমান অবহেলা মেনে নিতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগ লাইভে এসে আত্মহত্যা করে। এসব দেখতে দেখতে আমাদের স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এই সামাজিক অবক্ষয়ের মাঝে আমাদের বাচাঁবে কে?
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শিক্ষিত মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এসব আত্মহত্যার মাদ্রাসার ছাত্ররা অন্তর্ভুক্ত নয়। একজন মসজিদের ঈমাম বেতন পান ৫/১০ হাজার টাকা মাত্র। গ্রামের মসজিদের কোন ঈমামকে এই সামান্য বেতনের চাকুরী করে অভাবের কারণে আত্মহত্যা করতে দেখা যায়নি। সম্পদ মানুষকে সুখি করে এমন নয়, অভাবের কারনে আত্মহত্যা করে তাও না। অতিরিক্ত সম্পদের ক্ষুধা, অসন্তুষ্টির কারণে সন্তানদের পিতার সম্পত্তির লোভের দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে বহু পিতা আত্মহত্যা করতে দেখছি। মনে রাখবেন, মাদ্রাসার গরীব ও অশিক্ষিতের সন্তান বেশি আর বৃদ্ধাশ্রমে ধনী ও শিক্ষিতের মা বাবা বেশি।
আমি এক সময় মনে করতাম বৃদ্ধাশ্রমে গরীব মানুষ বেশি আশ্রয় গ্রহণ করেন। আসলে বাস্তবতা হলো উল্টো। প্রতি বছর রমজানে একবার বৃদ্ধাশ্রমে অসহায় মানুষের সাথে ইফতার করা আমার জন্য আনন্দের বিষয়। প্রথমবার আমি কিছু তরুণদের সাথে নিয়ে ইফতার সামগ্রী ও ঈদের নতুন শাড়ী-লুঙ্গি নিয়ে যখন বৃদ্ধাশ্রমে গেলাম।তখন দেখলাম ইফতার শেষে ঈদসামগ্রী গ্রহণ না করে অসহায় মানুষগুলো নিজ নিজ রুমে চলে গেলেন। অনেক আবেদনের পরও তারা আসলো না। কারণ জানতে চাইলে আশ্রম কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালেন, এখানে যারা আছেন তাঁরা অসহায় কিন্তু কেউ গরীবের মা-বাব নয়। দুস্থ অসহায় গরীবরা কেউ বৃদ্ধাশ্রমে আসে না। কারণ তারা ভিক্ষা করলে খাওয়া ও অর্থ দুটিইন পায়। তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম লাভজনক নয়। এখানে যারা আসে তারা ধনী এবং প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মা বাবা। তারা আপনাদের হাত থেকে ঈদের নতুন কাপড় নিলে সে ছবি সামাজিক যোগাযোগ এবং মিড়িয়া প্রচার হবে। এটি তাদের আত্মমর্যাদার পক্ষে হানিকর।তাই তারা ছবি তুলে ঈদসামগ্রী গ্রহণ করবে না। মানুষের আত্মমর্যাদা একটি বিশাল বিষয়। কথায় আছে, ‘গরীব ধনী হয়, ভিক্ষুক ধনী হয় না’। একজন মানুষ অর্থবিত্ত হারিয়ে যখন গরীব হয়,তাকে সাহায্য করলে সে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, কারণ সে তো অর্থ হারিয়েছে কিন্তু আত্মমর্যাদা হারাননি। যে ভিক্ষা করে তার তো আত্মমর্যাদা হারিয়ে গেছে। সে আর ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে না। কষ্ট করে সে আর আয় করতে চাবে না। এমন কি ভিক্ষুক একটি বিল্ডিং এর মালিক হলেও ভিক্ষা ছাড়ে না। আত্মমর্যাদা একটা ব্যক্তি ও জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরাজিত হয়। পরমানু বোমা হামলায় জাপানের হিরোসিমা নাগাসাকি ধ্বংস হয়। যে দেশটিতে এক ফোঁটা তেল গ্যাস এবং খনিজ সম্পদ নেই। যে দেশ প্রায় সময় ভূমিকম্পে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সে দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে কেউ কল্পনা করেনি। একমাত্র আত্মমর্যাদাই জাপানি জাতিকে বহুদূর নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে ছোট্ট একটি ঘটনা বলতে চাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিয়ে জাপানের রাজা স্বাক্ষর করার যখন প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এই রাষ্ট্র ও রাজার পরাজয় স্বচক্ষে না দেখার জন্য রাজার সামনে জাপানের আড়াইশত সৈনিক বেয়নেট দ্বারা আত্মহত্যা করে। তারা শির দেন কিন্তু আমামা দেয় না। কুকুর শুকরের মত না বেঁচে আত্মমর্যাদা নিয়ে অল্প সময় বেঁচে থাকা শ্রেষ্ঠ।আমাদের দেশের মানুষের আত্মমর্যাদা থাকলে এত বেহায়া হতে পারতো না। ত্রিশলক্ষ মানুষ রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। এত রক্ত খুব কম জাতিই বিসর্জন দিছে। আত্মত্যাগ করেছি অনেক কিন্তু আত্মমর্যাদা অর্জন করতে পারিনি। আত্মমর্যাদা থাকলে পর পর একটা জাতি পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় কী ভাবে।আসলে আমরা কাকে দোষ দিবো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়,কার নিন্দা করো তুমি মাথা করো নত/ এ আমার এ তোমার পাপ। সমাজ নষ্টের পিছনে আমরা একে অপরের দোষ দিচ্ছি। প্রকৃত পক্ষে আমরা জাতিগত ভাবে নষ্ট হয়ে গেছি। ছোট একটি খবর অনেক বড় নিউজ। শিক্ষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারী চাকুরীজীবীসহ অনেক শ্রেণীর হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল সম্মিলিত ভাবে জেলে সেজে সরকারি পুকুর লিজ নিয়েছে। একে বলে পুকুর চুরি। পুকুর চুরিতে জেলে সাজতে সমস্যা নেই। আত্মমর্যাদা না থাকলে তথাকথিত শিক্ষিতভদ্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে জেলে সেজে চুরিতে জড়াতে পারে, কোন ব্যক্তি মারা গেলে মৃতদেহটি দ্রুত মাটিতে পুঁতে ফেলা সম্ভব। কিন্তু কোন সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটলে তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা সম্ভব হয় না। নষ্ট সমাজ সংক্রামিত করে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকেধ্বংস করে। আত্মমর্যাদাশীল মানুষই প্রকৃতসুনাগরিক। বাঘ কী খায়? মাংস খায়। জীবন গেলেও ঘাস খায় না। আত্মমর্যাদাহীন মানুষ সুদ ঘুষ সবকিছুই খায়। হযরত শেখ সাদী (রহঃ) বলেছেন, বাঘ না খেয়ে মরলেও কুকুরের মত উচ্ছিষ্ট মুখে তুলে না।’
বর্তমান বিজ্ঞান প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। মানব উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে যাচ্ছি। মানব উন্নয়নের সাথে যদি মানবিক উন্নতির সূচকে যদি পিছিয়ে যাই তা হবে উন্নয়নের নামে হবে ‘টিউমার’, তা যত বড় হবে তত সমস্যা বাড়বে হবে।

লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn