সোমবার - ২৩শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৯ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২৭শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

শ্রমিকদের মজুরি নূন্যতম ২০ হাজার ও পরিসেবা আইন বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রামে বিএলএফের সংবাদ সম্মেলন

 

শ্রমিকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত এবং ২০ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশন এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

আজ ২৬ আগস্ট শনিবার সকালে নগরের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন হলে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন লেবার ফেডারেশন চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি নুরুল আবছার তৌহিদ।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গত ৬ এপ্রিল শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার লক্ষ্যে অত্যাবশ্যকিয় পরিসেবা বিল-২০২৩ মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান আইনে বে আইনী ধর্মঘটে শ্রমিকদের শাস্তির বিধান চলমান থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে শ্রমিক ও শ্রমজীবি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার পায়তারা চলছে। সংসদে এই বিল বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নিজেই উত্থাপন করেন। যা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। এই বিল পাশ হলে সরকার জনস্বার্থের অজুহাতে শ্রমিকদের দাবী আদায়ের সর্বশেষ হাতিয়ার ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে পারবে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের সর্বশেষ হাতিয়ার ধর্মঘটকে বে-আইনি ঘোষণার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ আইনে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার পায়তারা চলছে। মালিক পক্ষের কিছু অসাধু ব্যক্তি সরকারকে ভুল বুঝিয়ে তাদের হীনস্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা আইএলও কনভেশন ৮৭ ও ৯৮ দেওয়া শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করার সামিল।
শ্রমিকদের স্বার্থে এ পরিসেবা বিল ২০২৩ বাতিল করতে হবে।

তিনি লিখিত বক্তব্যে আরও দাবী করে বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফরা কর্মকালীন সময়ে মাইলেজ নামে একটি ভাতা পেয়ে থাকেন। যা রেল সূচনালগ্ন থেকে দেড় শতাধিক বছর যাবৎ রেলওয়ে কোডে বর্ণিত বিধান মোতাবেক পার্ট অব পে হিসাবে পেয়ে আসছেন। সম্প্রতি তাদের প্রাপ্ত এই বিধিবদ্ধ অধিকার খর্ব করার আদেশ জারী করা হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মধ্যে মারাত্মক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।অনতিবিলম্বে পূর্বের নিয়মে মাইলেজ প্রদান করে সৃষ্ট অচল অবস্থা নিরসনের জোর দাবী।

বাংলাদেশ রেলওয়ে’র জন্য সর্বশেষ প্রণিত নিয়োগবিধি-২০২০ জারি হওয়ার পর তা মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় শ্রমিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে তা দ্রুত সংশোধনের জন্য এক বছর আগে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবদি তা সংশোষিত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের পদোন্নতিতে মারাত্নক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। অন্য দিকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। এতে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার দানা বাধতে শুরু করেছে। অবিলম্বে নিয়োগবিধি-২০২০ সংশোধন করে শূন্য পদে নিয়োগ এবং প্রাপ্যক্ষেত্রে পদোন্নতি প্রদানের জোর দাবী।

সংবাদ সম্মেলনে বিএলএফ নেতা তৌহিদ বলেন, নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে গত ১ বছরে ১৩৪ জন নির্মাণ শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনার নিহত হয়েছে। এদেশের লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিকরাই বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বিলাশ বহুল শপিংমল, আলীশান বাড়ী, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলে কাজ করে। দেশের উন্নয়নে এই শ্রমিকেরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এক কথায় পৃথিবীর সৃষ্টি হতে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ পৃথিবীকে সাজিয়ে তুলতে তাদের অবদান অপরিসীম। নির্মাণ কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ন, নিরাপত্তাহীনতার মাঝে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে নির্মাণ শ্রমিক। নির্মাণ শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবী কর্মস্থলে নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদান, নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবহার করা, উচ্চ স্থানে কাজের সময় নিরাপত্তা বেল্ট ব্যবহার, পেনশন স্কিম চালু, রেশনিং ব্যবস্থা চালু, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, কর্মস্থলে আহত এবং নিহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপুরন প্রদান, নিয়োগ পত্র প্রদান সহ উক্তখাতকে ঝুঁকিপূর্ন পেসা হিসাবে ঘোষণা করার জোর
দাবী জানান।

তিনি লিখিত বক্তব্যে পাঠকালে আরও বলেন, ভারত, বিশ্বে জাহাজ ভাঙ্গা দেশের তালিকা খুব দীর্ঘ নয় ভারত, পাকিস্তান, চীন এবং বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙ্গা হয়। চীন তাদের নিজেদের জাহাজ ভাঙ্গে। বিশাল আয়তনের ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ বিগত ৩ বছর এই শিল্পে প্রথম স্থান ধরে রেখেছে। লাভের পরিমাণ বিশাল হলেও ইউরোপ থেকে এ শিল্পকে বিদায় করা হয়েছিলো। এশিয়ার এ অঞ্চলে আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের মূল লক্ষ্য হলো কম সময়ে কতটা লাভ করা যায়। সেই বিবেচনায় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প দিনদিন বৃহৎ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরের কন্টিনেন্টাল সেলফের গঠনও এই শিল্প বিকাশের অন্যতম নিয়ামক। শিল্পের অবকাঠামো নির্মাণ বা কর্মপরিবেশ উন্নয়নখাতে
মালিকদের তেমন কোন বিনিয়োগ করতে হয়নি। তখন কন্টিনেন্টাল সেলফের গঠনপ্রকৃতি, জোয়ার-ভাটার সাহায্য এবং শ্রমিকের শ্রম ও ঘামে জাহাজ টেনে এনে প্রকৃতি প্রদত্ত খোলা সৈকতে জাহাজগুলি ভাঙ্গার কাজ চলত।মালিকের মুনাফা ও সরকারের বিপুল রাজস্ব নিশ্চিত হলেও শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিক। জাহাজ ভাঙা শিল্পের হাজার হাজার শ্রমিকদের নায্য মজুরি দিতে হবে।

জাহাজ ভাঙ্গা ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা ২০১১ সালে হলেও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন হয়েছে ২০১৮ সালে।এ শিল্পে নিম্নতম মজুরী ১৬ হাজার টাকাও ঘোষিত হয়েছে ২০১৮ সালে। এর কোনটাই বাস্তবায়িত হয়নি। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ বা দেশের প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলায় মালিক বা সরকার কোন পক্ষই সহযোগিতা না করে বাধার সৃষ্টি করে, এতে শ্রমিকরা নায্য অধিকার হারাচ্ছে।

লিখিত বক্তব্যে আরো জানান, দেশে বর্তমানে ৭ কোটি শ্রমিক আছে। যাদের ৮৫ ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। ইপিজেড সহ নতুন নতুন গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় আইনি বাঁধা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারনে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে না। ফলে শ্রমিকরা সংখ্যায় বাড়লেও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে বাঁচার মতো মজুরী নির্ধারনের কথা উঠলেই সামনে আনা হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাত। শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবী জাতীয় নিম্নতম মজুরী নির্ধারনের বিষয় নিয়ে চলছে দীর্ঘসূত্রীতা, শ্রমিকদের সংগঠন গড়ার ও করার স্বাধীনতাকে নানাভাবে সংকুচিত করা হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় আমরা সেই পুরনো দাস প্রথায় ফিরে যাচ্ছি। অগনতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করে গণতান্ত্রিক শ্রমবান্ধব আইন প্রবর্তন করা, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মের পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে নিহত আহতদের ন্যায্য ক্ষতিপুরন নিশ্চিত করার জোর দাবী জানান বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাকিল আকতার চৌধুরী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এম নাজিম উদ্দীন, বিএলএফ এর জেলা শাখার সভাপতি সৈয়দ রবিউল হক শিমুল, সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মাইনু উদ্দীন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার ভুঁইয়া, আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু আহমদ, মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবু আহমেদ মিঞা প্রমুখ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn