
শ্রদ্ধেয় বাবা স্মরণে:
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন
২০০৩ সালের এই দিনটি (১৩ মার্চ) আমাদের পরিবারের জন্য গভীর শোকের দিন। সেদিন আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় পিতা, ডা. নুরুল হুদা সাহেবকে। আকস্মিকভাবে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছিলেন।
আগের দিন হঠাৎ তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে মন স্থির করেছিলাম পরদিন দেশে যাওয়ার। সারারাত ছটফট করেছি, ঘুম আসেনি। সকালে ছোট ভাই বাবুল জানাল, তিনি এখন ভালো আছেন। কিছুক্ষণ স্বস্তিতে থাকার পর হঠাৎ আবার ফোন এল। বাবুল জানালো, বাবা আর নেই। খবরটি শুনে যেন ভেঙে পড়েছিলাম। শোকের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে লন্ডন থেকে সপরিবারে ছুটে গেলাম চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামে পৌঁছে দেখি, তাঁর জানাজায় অংশ নিতে হাজার হাজার মানুষ শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসেছেন। সেই দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মুরাদপুরের বনগবেষণাগারের মাঠে। সেদিন অগণিত মানুষ চোখের পানি ফেলে তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছিলেন, “তাঁর চিকিৎসা সেবার অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়।”
চট্টগ্রাম শহরের আমাদের এলাকার মুরাদপুর মসজিদের সামনের কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনি শুধু একজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান মানুষ, দেশপ্রেমিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বোয়ালখালী, পাঁচলাইশের তৎকালীন অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন । একটি হাসপাতাল পরিচালনার দীর্ঘদিন সরকারি দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বৃটিশদের পরিচালিত আন্দরকিল্লাহর জেনারেল হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর থেকে প্রতিটা দিন ব্যয় করেছেন মানুষের সেবায় । বোয়ালখালীতে মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ায় তিনি ও তাঁর বড় ভাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন । বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ নিয়েছিলেন। মেডিকেল ছাত্রদের সভাপতি ছিলেন এবং চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, এম এ আজিজসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ছাত্রনেতা হিসেবে অত্যন্ত প্রিযভাজন ছিলেন । ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন ।সরকারি ও প্রাইভেট চিকিৎসার পাশাপাশি
চিকিৎসক হিসেবে গরীব অসহায় রোগীদের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছিল তখন তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ও সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন ।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তাঁর দুই সন্তানও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর দেখানো আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা আমার জীবনে দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। আমি চেষ্টা করেছি এবং এখনো করি, তাঁর মতো মানুষের ও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে।
আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্য তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাঁর নৈতিকতা, উপদেশ ও ভালোবাসার শিক্ষাগুলো আজও ভুলিনি। প্রতিদিন সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকে। বাবা, আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরজাগ্রত।