বাংলাদেশের ইতিহাসের কলংকজনক ব্যাংক লুটপাটে হোঁচট খেয়েছে দেশের উন্নয়ন এবং বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বার বার সরকার। গত এক দশকের আলোচিত কেলেংকারীঃ হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, নুরজাহান গ্রুপ, এস.এ.গ্রুপ, সিদ্দিক ট্রেডার্স, বেসিক ব্যাংক লুটপাট সহ নানাহ কেলেংকারীতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে শিল্পপতি নামধারী লুটেরা চক্র। এ লুটপাটে সরাসরি সহযোগিতা করেছে ব্যাংকাররা -অথচ জনগনের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সরকার। সরকারের কোন এমপি মন্ত্রী বা অন্য কেউ এ সুবিধা না নিলেও সকল দোষে দোষী শুধু সরকার।
সরকার বলতে সাধারণত সরকার প্রধানকেই মনে করা হয়। কারণ তিনিই তার মন্ত্রী নির্বাচন করেন। তিনি যে কোন সময় যে কাউকে তাঁর সরকারের অন্তভর্‚ক্ত বা বিদায় করার ক্ষমতা রাখেন।
ব্যাংকে লুটপাট সারা জীবনই হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু নিন্দুকেরা বলতে চাচ্ছেন সকল লুটপাট শুধু বর্তমান সরকারের সময়ই হচ্ছে বা হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছরের শাসনামলে সরকার প্রধান কোন ব্যাংকে একটি ঋণ প্রস্তাবের জন্য অনুরোধ করেছেন এমন কোন কথা তাঁর কট্টোর সমালোচকরাও বলতে পারেননা। প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর পরিবারে কোন সদস্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বা কোন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে এমন কথা গত ১৫ বছর ব্যাংক পাড়ায় শুনিনি। তাহলে সরকার কিভাবে দোষী হবে ?
হলমার্ক কেলেংকারীর পর সরকার শক্তহাতে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনেন। হলমার্কের চেয়ারম্যান এমডি সহ সোনালী ব্যাংকের বহু কর্মকর্তা জেলে গিয়েছেন – এখনো জেলে বিচারের অপেক্ষায় আছেন। সততার বিচারে অনন্য সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবীর বিদেশে পালিয়েছেন। হলমার্ক কেলেংকারীর ব্যাংক তথা সোনালী ব্যাংক শেরাটন শাখার ম্যানেজার ডিজিএম আজিজুর রহমানের বাড়ী ছিল গোপালগঞ্জ এবং তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর অবস্থানের কারণে হলমার্ক কেলেংকারির প্রায় সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে এবং গোপালগঞ্জের সন্তান পরিচয় দিয়েও ডিজিএম আজিজ কোন অনুকম্পা পায়নি সরকারের কাছ থেকে। জেলেই তার হার্ট এট্যাকে মৃত্যু হয়েছে।
বেসিক ব্যাংক কেলেংকারীর পর প্রায় সকল দুর্নীতিবাজ গ্রাহক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে এবং তৎকালিন এমডি কাজী ফখরুল সহ বহু গ্রাহক ব্যাংকার বিদেশে পালিয়েছেন। বহু টাকা খরচ করেও তৎকালিন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু দদকের মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করেত পারেনি। দুদক সম্প্রতি ৫৯টি মামলায় আবদুল হাই বাচ্চু , এমডি কাজী ফখরুল সহ দায়িদের বিরুদ্ধে চার্জশীট জমা দিয়েছে আদালতে।
অগ্রণী ব্যাংক লুটপাটের নায়ক এমডি আব্দুল হামিদসহ বহু গ্রাহক গ্রেফতারের ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। ডিএমডি মিজান গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছে এখন পলাতক।
বিসমিল্লাহ গ্রæপের এমডি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট গ্রæপ কেলেংকারীর নায়ক আব্দুল কাদের ২ বছর জেল খেটে টাকা পরিশোধের শর্তে জামিনে এসেছে। ক্রিসেন্ট গ্রæপ কেলেংকারীতে জনতা ব্যাংকের ডিএমডি ফখরুল সহ বহু ব্যাংকার জেলে গিয়েছে এবং কমপক্ষে ১৫ জন উর্ধ্বতন ব্যাংকারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এবং গ্রেফতার এড়াতে ঢাকা চট্টগ্রামের বহু লুটেরা গ্রাহক ও ব্যাংকার আত্মগোপনে গিয়েছে বা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এসআইবিএল এর সাবেক এমডি শফিকুর রহমান , মধুমতি ব্যাংকের সাবেক এমডি মিজানুর রহমান সহ ছোট বড় প্রায় শতাধিক ব্যাংকারের নামে দুদকের মামলা চলছে বা তারা পলাতক রয়েছেন।
অর্থাৎ ব্যাংকের যখনই কোন অনিয়মের ঘটনা সরকারের নজরে এসেছে তখন সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সরকার প্রধানের কঠোর অবস্থানের কারণে তথা জিরো টলারেন্সের কারণে লুটেরারা কোন ছাড় পাচ্ছেনা।
ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল এর লুটপাটঃ
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক পাড়ায় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল এর লুটপাটের কাহিনী। অথচ মাত্র দুই বছর আগেও ইসলামী ব্যাংক ছিল দেশের সেরা ব্যাংক। কোটি গ্রাহকের আস্থার ঠিকানা ইসলামী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংকটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৪০০ শাখা, ২৩০টি উপশাখা এবং প্রায় ৩ হাজার এজেন্ট শাখা নিয়ে কোটি গ্রাহকের সেবায় নিয়োজিত। সাবেক এমডি মাহবুবুর রহমানের সময় ও এটা ছিল দেশ সেরা ব্যাংক। মাত্র ২ বছরেই বর্তমান দুর্নীতিবাজ এমডির নেতৃত্বে একদল লুটেরা ব্যবসায়ী এটাকে দেউলিয়া করে তুলেছে। প্রধান নির্বাহী ও এমডি মনিরুল মওলা ২০২১ সালের জানুয়ারীতে যোগদান করেই শুরু করেন লুটপাট। নামে বেনামে এবং জামানত বিহীন হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ইসলামী ব্যাংককে তলানীতে নিয়ে এসেছেন তিনি। এমডি’র নেতৃত্বে একদল লুটেরা ব্যাংকার ১০% – ২০% ঘুষ নিয়েছেন বলে ইসলামী ব্যাংকের সর্বত্র আলোচনা রয়েছে।
কোন সাধারণ ব্যবসায়ীও কমিশন না দিয়ে ঋণ মঞ্জুর বা এলসি করতে পারছেনা। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সব টাকা মনিরুল মওলা বিদেশে পাচার করেছেন এবং সহসাই দেশ ত্যাগ করতে পারেন বলে ব্যাংক পাড়ায় গুঞ্জন রয়েছে।
এসআইবিএলও একই অবস্থা। এখানে লুটেরাদের মূল চালিকাশক্তি এমডি জাফর আলম। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা নামে বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে ব্যাংক থেকে এমডি জাফর আলমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তিনিও শতশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে তার নেতৃত্বাধীন একদল দুর্নীতিবাজ ব্যাংকার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বোর্ডে নিয়ে আসে। বোর্ড বিশ্বাসের উপর এমডির প্রস্তাবিত ও সুপারিশকৃত ঋণ অনুমোদন করেন। মুহুর্তেই সে ঋণের অর্থ ছাড় করানো হয়। এভাবেই কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে ব্যাংক থেকে। এমডি জাফর আলমের দুর্নীতি বন্ধ বা প্রতিহত করতে না পেরে ক্ষোভে দুঃখে পদত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও বোর্ড চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান।
ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের এমডির নিয়োগ বাতিল ও পাসপোর্ট জব্দ করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবী জানিয়েছেন এসব ব্যাংকের গ্রাহক ও সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর ভ‚মিকা না থাকলে ব্যাংক পাড়ায় লুটপাটের জন্য বারবার বিব্রত হবে সরকার ও প্রধানমন্ত্রী।