মঙ্গলবার - ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ২৮শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

রামাদ্বান ও তার পূর্ব প্রস্তুতি 

রামাদ্বান ও তার পূর্ব প্রস্তুতি 
এস এম জাকারিয়া
মহান আল্লাহ্ তায়া’লা অসীম দয়ালু ও মহা দয়াবান। তিনি সর্বপ্রথম আমাদের করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত। সেখান থেকে বাছাই করে আমাদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসেলের সাঃ উম্মত করে শ্রেষ্ঠ উম্মতের সনদ দিয়েছেন। এরপর আমাদের সন্মানকে আরো সমুন্নত করার জন্য দিয়েছেন মহিমান্বিত মাস মোহে রামাদ্বান। যে মাসের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সকল মাসের উপরে। যে মাসের বিশেষত্বই হলো বান্দাকে গুণাহমুক্ত করে তাক্বওয়াবান করা। আরবী ১২ মাসের মধ্যে একমাত্র এই একটি মাসের নামই কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে।
আল্লাহ তায়া’লা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ( ২:১৮৫ ) বলেছেন : ” রামাদ্বান মাস ঐ মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। “
একই আয়াতের অন্য অংশে আল্লাহ তায়া’লা বলেন : ” অতএব তোমাদের মধ্যে যারাই উক্ত মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন তাতে সাওম তথা রোযা রাখে। “
অন্যদিকে আল্লাহ তায়া’লা অত্র সূরার ১৮৩ নং আয়াতে সাওমের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলছেন : ” হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সাওম বলা রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপরও ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা মুত্তাকী তথা আল্লাহ ভীরু বান্দাহ হতে পারো। “
অর্থাৎ – আল্লাহ তায়া’লা রামাদ্বানে সাওম দিয়েছেন ফরজ ইবাদত হিসেবে। আরও প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ও পূর্ণ বয়স্ক তথা বালেগ নর-নারী মু’মিনের উপর তাক্বওয়াবান হওয়ার জন্য সাওম বা রোযা পালন করার অকাট্য নির্দেশনা আরোপ করেছেন।
তাহলে আমাদের জানা প্রয়োজন রামাদ্বান শব্দে মাসের নামকরণের হিকমত কী? আরবী রামাদ্বান শব্দের মধ্যে কী বিশ্লেষণ রয়েছে? আসুন জানার চেষ্টা করি…….
আরবী ” রামাদ্বান ” শব্দটি মধ্যে রা, মীম্, দ্বোয়াদ্ব, আলিফ্, নূন্ এই ৫টি হরফ নিয়ে গঠিত। এদের প্রত্যেক হরফেরই আলাদা বিশ্লেষণ দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন মোহাক্কেক আলেমের লিখ নিতে। যেমন :
১) ‘ রা ‘ হরফ দিয়ে রহমত বা দয়া, রমযুন্ বা আগুনে পোড়ানো, রিদ্বওয়ানুল্লাহ্ তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি।
২) ‘ মীম্ ‘ হরফ দ্বারা মাগফিরাত তথা ক্ষমা।
৩) ‘ দ্বোয়াদ্ব ‘ হরফ দিয়ে দ্বিয়াউন তথা আলো, দ্বিমানুল্লাহ্ তথা আল্লাহর দায়িত্ব।
৪) ‘ আলিফ ‘ হরফ দিয়ে উলফাত তথা ভালোবাসা।
৫) ‘ নূন্ ‘ হরফ দিয়ে নাজাত তথা মুক্তি, নূর তথা আলো, নিয়ামাতুল্লাহ্ তথা আল্লাহর নিয়ামত।
অর্থাৎ – রামাদ্বানে কেউ যদি একমাত্র আল্লাহ তায়া’লাকে রাযী খুশি করার উদ্দেশ্যে সিয়াম তথা রোযা পালন করে, তবে তা ঐ ব্যক্তির গুণাহগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাকে খাঁটি মু’মিনে পরিণত করে দিবে এবং আল্লাহর মাগফিরাত ও ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যমে ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে অর্জিত পূণ্যের আলো দিয়ে জান্নাতে পৌঁছে যাবে।
রামাদ্বানের পূর্ব প্রস্তুতি : হযরত আয়েশা রাঃ, হযরত উম্মে সালমা রাঃ সহ বেশ কয়েকজন সাহাবায়ে আজমাঈন থেকে জানা যায়, নবী করীম সাঃ রামাদ্বান আসার পূর্বে পুরো শা’বান মাস ব্যাপী যেসব প্রস্তুতি নিতেন তা হলো –
ক) শা’বানে রাসূল সাঃ বেশিবেশি সাওম পালন করতেন,
খ) রাসূল সাঃ নিজে শা’বানের দিনগুলো গণনা করতেন এবং অন্যদেরও এর দিনগুলোর হিসাব রাখতে বলতেন,
গ) বেশিবেশি নফল ইবাদত ও তওবা- ইস্তেগফারের মাধ্যমে যিকিরে লিপ্ত থাকতেন।
আর সাহাবাগণ দুনিয়াবি কাজকর্ম, লেনদেন, সবকিছু এমনভাবে গুছিয়ে নিতেন,যেন রামাদ্বানের পুরো একমাসের ইবাদতের কোন প্রকারের বিঘ্ন না ঘটে। অর্থাৎ তাঁরা সম্পূর্ণ রামাদ্বান মাস পুরোপুরি ইবাদাত করে কাটানোর জন্যই যেন দুনিয়াবি কাজকর্ম থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেতেন।
অতএব আমাদের উচিত –
ক) শা’বানে নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময়ানুযায়ী নফল ইবাদত করা,
খ) রাসূল সাঃ এর অনুসরণে শা’বানের ১ম দুই দশকে সাওম বলা রোযা পালন করার চেষ্টা করা,
গ) রামাদ্বানে ইবাদতের জন্য ব্যক্তিগত সময়সূচি করা, যেমন :
☞ চাকুরী বা ব্যবসায়ের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে জামাতে সালাত আদায়,
☞ চাকুরী বা ব্যবসায়ের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে নফল ইবাদতে মনযোগী হওয়া,
☞ প্রতিদিন পালাক্রমে অধিনস্থদেরও ফরজ সালাতসহ অন্যান্য সকল ধরনের নফল ইবাদতের সুযোগ দান,
☞ আত্মিক সংশোধন তথা সুদ, ঘুষের লেনদেন প্রত্যাহার, ব্যবসায়ে ভেজাল ও মিথ্যা পরিহার, যে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজ নিজ দায়িত্বের প্রতি সম্পূর্ণ যত্নবান হওয়া ইত্যাদি,
☞ যথাসম্ভব নিজের ঘরে খাবারের ব্যবস্থাপনা করা, যাতে কোনো প্রকারের বাড়তি মানসিক চাপ এসে ইবাদতের মনোযোগ ছিন্ন না করে।
ঘ) পারিবারিক প্রস্তুতি : রামাদ্বানের প্রস্তুতিতে পারিবারিক কিছু যৌথ কাজ রয়েছে। যেমন :
☞ পরিবারের নারী সদস্যরা যেন সবাই অন্তত এই একমাস নির্বিঘ্নে ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজেদের সালাত ও অন্যান্য নফল ইবাদত পালন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য ঘরে আলাদা ইবাদতের স্থান নির্ধারণ।
☞ বেশিবেশি ইফতারের খাবার তৈরি করে ইবাদতের সময় নষ্ট না করা, বরং স্বল্প একটা বা দুই পদে সন্তুষ্ট থেকে বাকী সময় ইবাদতের কাটাতে উৎসাহ প্রদান।
☞ রাসূল সাঃ এর অনুসরণে রাতে ঘরের নারীদের সহ জাগিয়ে দিয়ে একত্রে মিলে রাত্রিকালীন ইবাদত করা।
ঙ) সামাজিক প্রস্তুতি : মোহে রামাদ্বানকে স্বাগত জানানোর জন্য  সামাজিক কিছু প্রস্তুতি রয়েছে। যেমন :
☞ সমাজের সর্দার, মেম্বার, চেয়ারম্যান সহজ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মিলে নিজনিজ এলাকার সকলকে নিয়ে মিটিং করা। রামাদ্বানের পবিত্রতা কীভাবে রক্ষা করতে হবে তার বোঝানো ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া, বেরোযদার পাওয়া গেলে কী শাস্তি দেয়া হবে তার ঘোষণা করা।
☞ প্রতিটি পাড়ার মসজিদ গুলোতে তারাবিহর সালামের ব্যবস্থা করা, তারাবিহর নামাজের জামায়াতের সময় নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা,
☞ তারাবিহর সালাত আদায় করতে আগত মুসল্লীদের অনেক সময় কষ্ট হয়। সেজন্য মসজিদ পরিচালনা কমিটি মসজিদের ভেতরে বাড়তি লাইটিং সহকারে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করা। ওযুর ব্যবস্থাপনা পর্যাপ্ত করা। মসজিদের ভেতরে রামাদ্বান মাসে বাড়তি আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন সর্বপ্রথম ইসলামের ২য় খলিফা ফারুকের আযম হযরত ওমর রাঃ, যখন তিনি বিশ রাকাআত তারাবিহর সালাত জামায়াতে পড়ার নিয়ম করে দিলেন। যে আলোর ব্যবস্থার উপকারিতা দেখে শেরে খোদা হযরত আলী রাঃ দোয়া করেছিলেন এভাবে – ” হে ওমর! আপনি যেভাবে মুসল্লীদের সুবিধার্থে মসজিদে আলোকিত করেছেন, আল্লাহ্ তায়া’লা ঠিক সেভাবে আপনার জীবন ও সন্তানকে আলোয় ভরিয়ে দিন এবং আপনার মৃত্যুর পরে কবরের মধ্যে জান্নাতি আলো দান করুন “। আমীন।
চ) রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি হলো –
☞ দিনের বেলায় খাবারের দোকান ( মুসলিম ) বন্ধ রাখার বিষয়ে কঠোর হুকুম জারী, অমান্যকারীর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা। পুরো রামাদ্বান জুড়ে এই আইন প্রয়োগ কারি তদারকি কমিটি গঠন ও নিযুক্ত করণ,
☞ বাজার দাম নির্ধারণ ও মূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ,
☞ জনমনে স্বস্তি থাকবে এমন আইনি পরিবেশ সৃষ্টি, যেন জনগণ নির্বিঘ্নে সিয়াম পালন ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগী করতে পারে,
☞ সবাই ধরনের নৈরাজ্য বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ,
☞ অফিস এর রামাদ্বান মাসের জন্য নতুন সময়সূচি নির্ধারণ,
☞ চাঁদ দেখা কমিটি গঠন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব প্রদান, যেনো জনগণ সঠিক সময়ে সঠিক বিষয়টি জানতে পারে। তবে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত,  রাসূল সাঃ উম্মতের সকলকেই চাঁদ দেখার প্রতি আদেশ দিয়েছেন। যার কারণে রামাদ্বানের সুন্নাত আমল গুলোর অন্যতম একটি হলো ” নতুন চাঁদ দেখা “।
সর্বোপরি রামাদ্বান মাস আসছে, একটা বছর পরে আবার আমরা মহিমান্বিত মাস রামাদ্বানের সিয়াম পালন তথা রোযা রাখার, ইবাদত করে গুনাহের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। একারণে আল্লাহর শুকরিয়া স্বরুপ প্রতিদিন সার্বক্ষণিক যখনি সময় হয় নিজেকে হামদ, ছানা, তাসবীহ, তাহলীলে লিপ্ত রাখতে হবে।
লেখক : সহ. সুপার, চিশতিয়া বজল আহমদ ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা, মীরসরাই, চট্টগ্রাম।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn