শনিবার - ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১২ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক কূটনীতিতে ছেদ ঘটাল বেলুন

বাণিজ্য, তাইওয়ান এবং ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে সরাসরি সাক্ষাতেও অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে সম্পর্ক ঝালাই করতে এবং মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু একটি বেলুন সেই সফরকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। উলটো আবারও দুই দেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, গোয়েন্দা নজরদারির সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতিগুলোর একটি বেলুন।

কূটনীতিতে বেলুন ঝড়
আমেরিকার স্পর্শকাতর পরমাণু কেন্দ্রগুলোর ওপর নজরদারির জন্য গুপ্তচর বেলুন ব্যবহার করছে চীন। গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন এই দাবি করে। মার্কিন আকাশে বেলুনটি দেখা যাওয়ার পর একপ্রকার কূটনৈতিক সংকট শুরু হয়। এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে একে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ আখ্যা দিয়ে সপ্তাহ শেষে চীন সফরের পরিকল্পনা বাতিল ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের আরেক দফা অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেলুনটি দেখার পরই তা গুলি করে নামানোর ওপর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। দুই দলের আইনপ্রণেতারাই চীনকে এর জবাব দিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে আহ্বান জানান। কিন্তু বাইডেন গুলি করে নামাতে চাননি। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে তাকে সেই নির্দেশও দিতে হয়। শনিবার সেটি যুদ্ধবিমান দিয়ে গুলি করে নামানো হয়। পেন্টাগন জানিয়েছে, আমেরিকার জলসীমার মধ্যেই তাদের ফাইটার বিমানগুলো দিয়ে বেলুনটিকে গুলি করে নামানো হয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একটি এফ-২২ ফাইটার বিমান বহু উঁচুতে উড়তে থাকা বেলুনটিকে একটি এআইএম-৯এক্স সাইডউইন্ডার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আঘাত করে। এরপর সেটি যুক্তরাষ্ট্র সাউথ ক্যারোলিনা উপকূলের প্রায় ৯ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে পড়ে যায়। সাগরে প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বেলুনটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

গতকাল রবিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, চালকবিহীন বেসামরিক আকাশযানটিতে হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যে শক্তি ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে চীন তীব্র অসন্তোষ ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে আরো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এ অভিযানকে ‘ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন করেছে চীন। আর এর জবাবেই অভিযানটি চালানো হয়েছে।

গত নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বৈঠক করেছিলেন। দুই নেতা পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিলেন। এর আগে গত বছরের আগস্টে তৎকালীন মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। তাইওয়ানের চারপাশে সামরিক মহড়া চালায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ব্যাপক বাগিবতণ্ডা হয়। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বেইজিংয়ের মস্কোর পক্ষ নেওয়া নিয়ে আগেই ক্ষুব্ধ ছিল ওয়াশিংটন। আমেরিকা কোনোভাবেই দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখছে না। সম্প্রতি ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে দেশটি। খবর প্রকাশ হয়েছে যে, চীনের চারদিকে সামরিক ঘাঁটির মালা তৈরির চেষ্টা করছে আমেরিকা। এর মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চলতি সপ্তাহে চীন সফরের কথা জানানো হয়। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের মাথায় সেই পরিকল্পনাও ভেস্তে গেল বেলুনের কারণে। তবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে ব্লিনকেনের সম্ভাব্য সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। হোয়াইট হাউজ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাবেক এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক ইভান কানাপাথি মনে করেন, কংগ্রেসে এই সফর নিয়ে শুনানি হওয়া উচিত। কারণ চীনে বন্দি আমেরিকানদের ফিরিয়ে আনতে না পারলে কোনো লাভ হবে না। আর এমন সফরের প্রয়োজনও নেই। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনে চীনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রায়ান হ্যাস বলেন, এই বেলুন অন্তত যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে আকাশে যান ব্যবহার করার বিষয়ে একটি চুক্তিতে নিয়ে আসার সুযোগ করে দেবে। আকাশসীমা লংঘনের বিষয়ে তারা একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারে বলে মনে করেন হ্যাস।

আমেরিকার আকাশে গেল কীভাবে?
বেলুন কাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। গণমাধ্যমটি জানায়, মন্টানার বিলিংস শহরের আকাশে দেখা যাওয়ার আগে এটি আলাস্কার অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং কানাডার মধ্য দিয়ে উড়ে এসেছে। এ ধরনের বেলুন সাধারণ হিলিয়াম গ্যাসে ভরা বেলুন হয়ে থাকে। এটি আকাশের অনেক উঁচুতে উড়তে সক্ষম হয়। বেলুনের নিচের অংশে একটি সৌরশক্তির প্যানেল থাকে, যা থেকে বেলুনটি পরিচালনার শক্তি যোগানো হয়। এর নিচেই ক্যামেরা, রাডার, সেন্সর এবং যোগাযোগের সরঞ্জামগুলো থাকে। চীন দাবি করেছে যে, ওয়েস্টারলিস বাতাসে বেলুনটিকে তার নির্দিষ্ট পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। বিবিসি ওয়েদারের সিমন কিং জানান, চীন এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে নর্থ প্যাসিফিকে যে বাতাস বয়ে থাকে, তাকে বলা হয় ওয়েস্টারলিস। এটা সাধারণত পশ্চিমে তৈরি হয়ে পূর্ব দিকে বয়ে যায়। তার মতে, গত কয়েক দিনে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ফিট উচ্চতায় বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৫০ মাইল (২৪০ কিলোমিটার) বা তার চেয়ে বেশি। ঐ উচ্চতায় বাতাসের এরকম গতিবেগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। গত কয়েক দিন ধরে সেখানে বাতাসের যে গতিবেগ রয়েছে, তাতে বেলুনটিকে আলাস্কার ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কানাডা হয়ে মন্টানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সিমন। তিনি জানান, ‘বেশির ভাগ ওয়েদার বেলুন ১ লাখ ফিট উচ্চতায় ওড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরে সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো প্যারাসুটের মাধ্যমে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এটার মতো এতদিন ধরে এরকম একটি বেলুনের আকাশে ওড়া বেশ অস্বাভাবিক।’ কিংস কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষক ড. মারিনা মিরন বলছেন, ‘চীন যতটা দাবি করছে, বেলুনটি হয়তো তার চেয়েও বেশি অত্যাধুনিক। হয়তো বেলুনটি ভূমি থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকতে পারে। ফলে তারা সেটিকে উঁচুতে তুলে বা নিচে নামিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যাতে সেটি বিভিন্ন বাতাসের গতি ব্যবহার করে নানা দিকে যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আপনি হয়তো একটি জায়গায় স্থির থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে চান। এমন কিছু আপনি বেলুন দিয়ে করতে পারবেন, যা স্যাটেলাইট দিয়ে পারবেন না।’

স্যাটেলাইট থাকতে বেলুন কেন?
বেলুন হচ্ছে গোয়েন্দা নজরদারির সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতিগুলোর একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিসংযোগকারী বোমা হামলা করতে জাপানিরা বেলুন ব্যবহার করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও ব্যাপকভাবে নজরদারি করতে বেলুন ব্যবহার করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে জানা যাচ্ছে যে, অনেক উঁচুতে উড়ে নজরদারি করতে পারে, পেন্টাগনের নেটওয়ার্কে এরকম বেলুন যুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

আধুনিক যে বেলুনগুলো রয়েছে, সেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৪ থেকে ৩৭ কিলোমিটার অর্থাৎ ৮০ হাজার ফুট থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়তে পারে। এয়ার-পাওয়ার বিশেষজ্ঞ হে ইয়ুন মিং বিবিসির কেলি নগকে বলেছেন, ‘বেইজিং হয়তো ওয়াশিংটনকে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, আমরা যেমন সম্পর্ক ভালো করতে চাই, তেমনি যে কোনো রকমেই হোক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যও প্রস্তুত আছি।’ তিনি মনে করছেন, যেভাবে বেলুনটি নির্দিষ্ট একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটির কাছাকাছি উড়ে গেছে, তাতে সেটি পথভ্রষ্ট হয়ে সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কার্নেজ কাউন্সিল ফর এথিকস ইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষক আর্থার হল্যান্ড মাইকেল বলছেন, ‘এমন হতে পারে যে, এই বেলুনটা শনাক্ত হওয়াটাই চীনের উদ্দেশ্য ছিল। তারা হয়তো দেখাতে চায় যে, তাদের এরকম স্পর্শকাতর প্রযুক্তি আছে, যা বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি না করেও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে পারে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, স্যাটেলাইট বা ড্রোনের তুলনায় বেলুনের বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। একটি কম ব্যয়বহুল এবং খুব সহজেই মোতায়েন করা যায়। স্যাটেলাইট তার নিজের কক্ষপথেই ঘুরতে থাকে। কিন্তু বেলুন যে কোনো জায়গায় পাঠানো যায়। ড্রোনের তুলনায় এটি অনেক ধীরগতিতে ওড়ে বলে অনেক সময় নিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে নজরদারি করা সম্ভব।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn