শনিবার - ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মহান মে দিবসের ভাবনা

মহান মে দিবসের ভাবনা

উজ্জ্বল বিশ্বাস

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর সংহতি দিবসের দিন ১ মে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শ্রমিকের শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার বাস্তবায়নের দাবিতে চেতনাজাগ্রত হয়ে ওঠার দিন। শ্রমের উপর ভিত্তি করে মানব সভ্যতার সূচনা হলেও শুরু থেকে শ্রমিকের মর্যাদা বলে কিছুই ছিল না। শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা ছিল খুব নাজুক। শ্রমিকদের নাম মাত্র মুজুরী দিয়ে মালিকরা ইচ্ছামত কাজ করাতো। তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট কর্ম ঘণ্টা ছিল না। এর প্রতিবাদ করলে মালিকরা চালাতো নির্যাতন। শ্রমিকদের ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজে লাগিয়ে মালিকরা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। এ সময় শ্রমিকরা সংগঠিত ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন করে তারা ক্ষতি ও নির্যাতনের শিকার হতো। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকায় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় নব্য পুঁজিপতির উদ্ভব ঘটে। ক্রমান্বয়ে তাদের ভয়ঙ্কর চেহেরা উন্মেচিত হয়। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আমেরিকার শহরে সর্বস্তরের শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সমিতি ও ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে লাগল। শ্রমের নায্য মুজুরী ও ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৮৮৪ সালে আমেরিকার লেবার ফেডারেশন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে জোরদার করে তোলে। মালিকরা দাবি না মানলে অনির্দিষ্টকাল ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৮৮৬ সালে ১ মে ধর্মঘট পালনের তারিখ নির্ধারিত হয়। সকল শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট পালনের একাত্মতা ঘোষণা করে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের আন্দোল নস্যাৎ করতে অত্যাচার, হত্যা, গুম করার পথ বেছে নেয়। ১ মে ধর্মঘটের দিনের পূর্বে ৭ এপ্রিল মিসিসিপির এক কারখানা ৮ শ্রমিককে হত্যা করে লাশ মিসিসিপি নদীর তীরে ফেলে রাখে। এতে আন্দোলন জ্বলে ওঠে। ১৮৮৬ সালে ১ মে আন্দোলন চরম অবস্থায় পৌঁছায়। আমেরিকার শিকাগো শহরে হেয় মার্কেটের জুতার কারখানার শ্রমিকগণ রাস্তায় নেমে ধর্মঘটে একাত্মতা ঘোষণা করে। মালিকদের পোষা গুন্ডাদের দিয়ে ধর্মঘটি শ্রমিকদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। আন্দোলন প্রতিহত করতে ৩ মে হে মার্কেটে আহত ধর্মঘটের শ্রমিক সমাবেশে লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে ৬ শ্রমিক নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৪ মে প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ আবারো গুলি চালায়। এতে ৫ শ্রমিক নিহত হয়। সমাবেশে শ্রমিক নেতা পার্সন্স ও ন্সাইজ বক্তৃতা করেন। প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে প্রবল বৃষ্টির কারণে সভাস্থল থেকে লোকসমাগম কমতে থাকে। এ সুযোগে কুখ্যাত এক পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে ১৮০ জনের পুলিশ বাহিনী সভাস্থলে পৌঁছায়। পুলিশের প্রতি বোমা হামলার অভিযোগ এনে পুলিশ সমাবেশে গুলি চালায়। এতে ৫ জন নিহত ও শত শত আন্দোলনকামী শ্রমিক আহত হয়। পুলিশ শ্রমিকদের গ্রেফতার ও দমন পীড়ন নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে ৮ শ্রমিকের বিচার করা হয় এবং কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ৮ জন শ্রমিক নেতা হলেন- এ্যালবার্ট পার্সস, আগাস্টাস স্পাইজ, স্যামুয়েল ফিভেন, মাইকল শোয়াব, জর্জ এঞ্জেল, লুই লিঙ্গ, অ্যাডাল ফিফার ও ওস্কার নিব। বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে পার্সন্স, স্পাইজ, জর্জ এঞ্জেল ও ফিফারের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির আগের রাতে লুই লিঙ্গ আত্মহত্যা করে। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনবের গভর্নর অভিযুক্ত ৮ শ্রমিক নেতাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেন এবং পুলিশ অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এভাবে প্রাণের বিনিমিয়ে শ্রমিক শ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার আদায় করে।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারীসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রতিবছর ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসাবে বা মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহের সরকারী প্রতিনিধি ও শ্রমিক-মালিক সংগনের প্রতিনিগনের সমন্বয়ে শ্রমজিবীদের ন্যায় সংগত সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। আজ সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সরকারীভাবে দিবসটি পালন হচ্ছে। শ্রমিকের নির্দিষ্ট শ্রম ঘণ্টা, ন্যূনতম মুজুরী, বেতন বৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্দোলন চলমান। এখন উন্নত দেশে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, সম্মানজনক হলেও উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের ভাগ্য বদল হয়নি। বাংলাদেশ জেনেভা কনভেশনে স্বাক্ষর করে শ্রমজীবীদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। একাধিক আইএলও কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেও কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও সাংবিধানিক আইন আমান্য করে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানায় শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্যতম বৃহৎ শ্রম সেক্টর বিশেষ করে সড়ক পরিবহন শিল্প দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি এই পরিবহন খাতে কর্মরত প্রায় ৮০ লক্ষ শ্রমিকদের নেই কোন শ্রম আইন স্বীকৃত অধিকার। করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের সুবাদে কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের অপকৌশলে দ্রব্য মুল্যের উর্দ্ধগতির আগ্রাসনে সড়ক পরিবহন খাতের হালকা যানে শিশু শ্রম ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মহীনতা, মুজুরী কর্তনের ভয়াবহতায় হোটেল রেষ্টুরেন্ট শ্রমিক, আবাসিক হোটেল শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, হেলথ এন্ড ডায়াগনস্টিক কর্মচারী, ডেকোরেটার ও কমিউনিটি সেন্টার শ্রমিক, নির্মান শ্রমিক, ঘাট ও গুদাম শ্রমিক, হকার শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, পাদুকা শ্রমিকরা। রপ্তানি নির্ভর তৈরী পোষাক শিল্পে প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করছে। তারা বেতন বৈষম্যসহ নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিকরা আহত ও প্রাণ হারাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তাদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। চতুর্থ শিল্পায়নের বিশ্বে উৎপাদনে আধুনিকতার ফলে পাট ও বস্ত্র শিল্পের ন্যায় তৈরী পোষাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীরাও কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনা আসন্ন। এ বিষয়ে সরকারের উচিত যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহন। সকল শ্রেণী-পেশার শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় আইন আছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক কথায় খাতায় আছে গোয়াল শূণ্য। মে দিবসে অনুষ্ঠানে নেতাদের বক্তৃতায় প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। এখন মে দিবস পালন করা হয় কোথাও শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে, আবার কোথাও আনন্দ-উল্লাসের উপলক্ষ্য হিসাবে। পালন করা হয় সরকারী উদ্যোগে মে দিবসের আনুষ্ঠানিকতায়। থাকে নানা ধরনের জাতীয় শ্লোগান। মুলত শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি কোন পক্ষেই যথেষ্ট আন্তরিক নয়। এ কারণে শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। মহান মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সমতার ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় মানবতার ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যাবস্থা বিবেচনায় সরকার ও সংশ্লিষ্টদের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সমন্নত রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেও শ্রমজীবীদের সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চাই ঐক্য শ্রমিক মালিক সম্প্রিতির বন্ধনে গড়ে তুলতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

জয় বাংলা
জয় হোক মেহনতি মানুষের,
জয় হোক মানবতার।

 

উজ্জ্বল বিশ্বাস
ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক
জাতীয় শ্রমিক লীগ
চট্টগ্রাম মহানগর।
সহ সভাপতি
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn