মঙ্গলবার - ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২৪শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

ভারী পকেটের নিচে আত্মার কান্না

ভারী পকেটের নিচে আত্মার কান্না

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
———————–
শতকের বাইরে পারসেন্টেইজ আসে না।যা পারসেন্টেইজ আসে না তা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করি। এটি যে বিতর্ক নয়, কুতর্ক তা বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। ব্যতিক্রম যুক্তি নয়, ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। এই ব্যতিক্রমধর্মী কিছু লোক বাদ দিলে আজ আমরা সকলেই নিজের পকেট ভারি করতে ব্যস্ত, কিন্তু পকেটের নিচে যে একটি আত্মা আছে সে আত্মাটিকে নষ্ট করছি। আত্মাকে প্রসারিত করতে না পারলে অর্থ অনর্থে পরিণত হয়। যে সম্পদের জন্য নিজের আত্মা নষ্ট করছি সে সম্পদের কোথায় শুরু, কোথায় শেষ দুনিয়ার কেউ জানে না।
ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন, আর্থিক অবস্থানের দিক চিন্তা করলে একটি পরিবার তিন অবস্থা থাকে। ত্যাগ, ভোগ, ধ্বংস। গরিব ঘরের সন্তানরা শত সংগ্রাম করে বিত্তশালী হয়। সে সম্পদ তার সন্তান, নাতি, পুতিরা ভোগ করে।তারপর সব সম্পদ শেষ হবে। এই কথাটি আইউব বাচ্চু তাঁর গানের মধ্যে তুলে ধরেছেন, ‘এক পুরুষে কামাই ধন / আরেক পুরুষ খায় / আরেক পুরুষ আইসা দেখে খাওয়ার কিছু নাই / আমার তিন পুরুষ।’ তারপরও মানুষ সম্পদের পিছনে দৌড়তে থাকবে। শেক্সপিয়র বলেছেন, সৌন্দর্য, অর্থ ক্ষমতা এই তিন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ সব মানুষের থাকবেই। পৃথিবীতে এক টাকার সম্পদ বাড়ছে না, আবার কমছেও না, শুধু সম্পদের হাত বদল হচ্ছে। অন্য গ্রহ হতে পৃথিবীতে সম্পদ নিয়ে আসা এখনো সম্ভব হয়নি। তাই লিও টলস্টয় বলেছেন, ‘একজন মানুষ ধনী হওয়া মানে দশজন মানুষ গরিব হওয়া’। যে অঞ্চলে যত বড় বড় জমিদার বসবাস করে সেখানে তত বেশী গরিব শ্রেণীর মানুষ বাস করে।
সম্পদের প্রতি নেশা মানুষকে উম্মাদ করে ছাড়ে। মানুষ সম্পদ হারানোর বেদনা সহ্য পারে না। মনীষীরা বলেগেছেন,পুত্র হারানোর বেদনা মানুষ ভুলতে পারে,সম্পদ হারানোর বেদনা মানুষ ভুলতে পারে না। মানুষ সম্পদ হারানোর পর স্ট্রোক করে, উন্মাদ হয়, অসুস্থ হয়, আত্মহত্যা করে। এত মানুষ পুত্র হারানোর শোকে অসুস্থ ও আত্মহত্যা করে না।
শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় লেখা আছে, এমন কী হারিয়েছো তুমি যা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলে,যা পেয়েছো তা কিছুদিন পূর্বে আরেকজনের ছিলো, এখন আরেক জনের কাছে গেছে, পরিবর্তনই জগতের নিয়ম, এটি মেনে নিতে হয়। দুনিয়াতে আমরা সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসিনি। দুনিয়াতে যা পেয়েছি তা তো আমার ছিল না। দুনিয়া হতে যাওয়ার সময় কিছু নিতে পারবো না। কবরে টাকা চলে না। ‘দি লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’ শেষ কাপড় (কাফনের কাপড়)’র পকেট নেই।
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট মৃত্যুর পূর্বে তিনটি অসিয়ত করে গেছেন, কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর লাশটা যেন ডাক্তারদের কাঁধে তুলে দেন। কারণ ডাক্তাররা দাবী করে তারা মানুষকে বাঁচান, সব কিছুর বিনিময়ে তারা আমাকে বাঁচাতে পারলো না। তারা মিথ্যা বলেন। আর আমার জমানো সব সম্পদ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিবে। কারণ এই সম্পদ নিয়ে যেতে পারলাম না। আমার কোন কাজে আসবে না। আর আমার দুটি হাত কফিনের বাইরে প্রসারিত রাখবে। কারণ বিশ্ববাসী দেখুক বিশ্ব বিজেতা বীর আলেকজান্ডার দুনিয়া হতে খালি হাতে ফেরা যাচ্ছে।
অঢেল সম্পদের অর্থ নেই, তারপরও মানুষ সম্পদের নেশা ত্যাগ করতে পারে না। সম্পদ যতই কম বেশি হোক কিন্তু রুটির সাইজ সমান। তাই হালাল রুজি অর্জন খুবই প্রয়োজন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এত অবৈধ অর্থ অর্জন করতে হয়? সোজা কথায় ভবিষ্যৎ বলতে আমি বুঝি কবরস্থানকে। তার জন্য প্রস্তুতি দরকার। অর্থ দিয়ে মানুষের অভাব দূর করা সহজ, কিন্তু স্বভাব দূর করা কঠিন। টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনা যায়, কিন্তু সময় নয়। টাকা দ্বারা বাড়ি নির্মাণ করা যায়, কিন্তু শান্তি নয়। টাকা দ্বারা সেরা দামি খাট কেনা যায় কিন্তু ঘুম নয়। টাকা দিয়ে নারীর দেহ ও মন পাওয়া যায় কিন্তু ভালোবাসা নয়, অর্থ দিয়ে বই কেনা যায় কিন্তু জ্ঞান নয়, টাকার জোরে তোষামোদকারী পাওয়া যায় কিন্তু ভালোবাসার মানুষ নয়। টাকা দিয়ে ক্ষমতা পাওয়া পায়, সম্মান নয়। টাকা দ্বারা ধনী হওয়া যায় কিন্তু আদর্শবান নয়, টাকা দিয়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) দুনিয়া পাওয়া যায় কিন্তু জান্নাত নয়। মনে রাখা দরকার বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন আছে কিন্তু টাকাই সবকিছু নয়।
সফলতা জন্য অর্থবিত্তের পিছনে ম্যারাথন দৌড়তে গিয়ে হৃদয়হীন যন্ত্রে পরিণত হচ্ছি। সব সময় কাজ করা কোন কাজই না।কাজের গতি বাড়াতে নিজকে সময় দিতে হয় তা যেন আমরা ভুলতে বসেছি।কাজের ফাকে সৃজনশীল মন নিয়ে ভাবতে হয়। অন্যতম সেরা ধনী ওয়ারে বাফেট বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে আমি চুপচাপ বসে ভাবি। অনেকে বলতে পারেন এটি নিরর্থক। ব্যবসা ও বিনিযোগ নিয়ে ভাবতে হয়। জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, ধর্মগুরুরা ভাবেন। সৃজনশীলতা আসে কল্পনা
শক্তি হতে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলতেন, জ্ঞানের চেয়ে কম্পনা শক্তি অনেক বড়।
মানুষ সুখি হতে অনেক কিছু চায়। এই অনেক চাহিদার মধ্যে যে সুখ নাই তা বুঝার ক্ষমতা কম মানুষেরই আছে। দুঃখ সুখের নিকট প্রশ্ন করলো, তুমি কেমন আছে? সুখ বললো, বড় দুঃখে আছি ভাই। কারণ সুখের চাহিদা এত বেশী বেড়ে গেছে, এত সুখের চাহিদা পূর্ণ করতে গিয়ে বড় দুঃখে পড়েছি। একটা সুখের বস্তু পূর্ণ করলে আরো সুখের চাহিদা হাজির হয়। এত বেশী সুখের বস্তু পূর্ণ করা অসম্ভব বলে বড় দুঃখে পড়েছি।
দুই ধরনের লোক নাকি সুখি হয়। যে ব্যক্তির আত্মসন্তুষ্টি আছে আর যে লজ্জা শরমহীন বেহায়া। আত্মসন্তুষ্ট মানুষের সংখ্যা কমছে। বেহায়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এখন মনে হয় মানুষ বেহায় হয়ে সুখি হতে চায়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সৎ মানুষ সুখে থাকা কঠিন। তাদের দুইদিকে লড়াই করতে হয়। এক দিকে দরিদ্রতা, অন্যদিকে অসৎ মানুষের নোংরা চক্রান্ত।
সৎ মানুষ সুখি না হলেও মানসিক শান্তি অসৎ লোক হতে কম নয়। জীবনের দুঃখ না থাকলে সুখ অনুভব করা যায় না। জীবনের সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে গেলে মনের শান্তি চলে যায়। অপূর্ণতাই সংগ্রামী পথে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবনে দু:খ কষ্টের চেয়ে সাহসের ক্ষমতা অনেক বেশি।দু:খের নিকট পরাজিত হয় তারা যাদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।
শুধু আর্থিক উন্নতি মানুষকে সুখি করতে পারে না। উন্নত দেশ আমেরিকা ও চীনের দিকে তাকান, সেখার ধনীদের নতুন প্রজন্ম দ্রুত হতাশ ও উদ্যমহীন হয়ে পড়ছে। ২০০৯ সালে আমেরিকার মাধ্যমিকের ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও বিষণ্ণতা কাজ করে। বার বছর পর ২০২১ সালে সেই সংখ্যা ৪৪ শতাংশ হয়েছে। বর্তমান আরো দ্রুত বাড়ছে। চীনের প্রজন্মেরও একই অবস্থা। অবৈধ অর্থের মালিক বনে তথাকথিত বিখ্যাত না হয়েও সুন্দর জীবন কাটানে যায়। অসুন্দর অসুখি জীবন যাপন করে বিখ্যাত হওয়ার মাঝে জীবনের সার্থকতা নেই। অতিরিক্ত সম্পদ যেমন ভালো নয়, তেমনি অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। অতি অর্থ অনেক। আর রিত্ত অর্থ শূন্য। অতিরিক্ত মানে অনেকগুলো শূন্য। তাই দার্শনিক কনফুসিয়াস ও জালাল উদ্দিন রুমি দুইজনই বলেগেছেন মাত্রাতিরিক্ত সবই বিষ’।
আজ মাত্রাতিরিক্ত অর্জনের নেশায় আমার মধ্যে আরেকটা আমি আছে, সেটার মৃত্যু ঘটাচ্ছি। বাইরের পোশাক আশাকে বুঝ যায় না কোনটা মানুষ আর কোনটা অমানুষ। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) বলেছেন, আমি অনেক মানুষ দেখেছি, যাদের শরীরে কোন পোশাক নেই। আমি অনেক পোশাক দেখেছি যার ভিতরে মানুষ নেই। মানুষ চিনতে ভুল করার মধ্যে কোন দোষ নেই, কারণ অমানুষগুলো দেখতে মানুষের মত।

লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn