মঙ্গলবার - ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ২৮শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১২ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্যে নারী

সুমনপাল ভিক্ষু : বৌদ্ধ সাহিত্যে এবং বৌদ্ধধর্মে নারীর ইতিহাস হল অগ্রগতির একটি রৈখিক কাহিনী যা নির্যাতন থেকে মুক্তিতে এসে পৌঁছেছে। নারী বিদ্বেষী মনোভাবযুক্ত পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ বৌদ্ধধর্মে স্থান পায়নি। নারীর অবস্থান ও লিঙ্গের সমতা নির্মাণ সমর্থন করে বৌদ্ধধর্ম এবং লিঙ্গসমতা কেন্দ্রিক বা সমমনোভাবাপন্ন একথা অনস্বীকার্য।

নিষ্ক্রিয় সাংস্কৃতিক বিষয় হিসেবে নারীর চিরাচরিত ভূমিকার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্য বৌদ্ধ নারীর সক্রিয় রূপ থেরীগাথা।

লিঙ্গ বিষয়ক আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্যভাবে দাবী করে, অতীত জনসংখ্যার অর্ধেক মহিলাদের সম্পর্কে তথ্যকে অবহেলা করে তা কখনই নিখুঁত হতে পারে না। অভিনেত্রী এবং লেখিকা হিসেবে মহিলাদের ইতিহাসে যতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার লাভ করার কথা ছিল তারা ততটা পাননি। রোমিলা থাপার মন্তব্য করেছেন, লিঙ্গ অধ্যয়ন শুধুমাত্র মহিলাদের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বেশী তথ্যের সংগ্রহ নয়, মহিলাদের মতামত ও ক্রিয়াকলাপে একত্রিত করা। বিশেষ বিশেষ সামাজিক রূপ মহিলাদের উপর নিয়ন্ত্রণের নকশা হয়ে ওঠে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। আগে মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী, গার্গীর দার্শনিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বা সরকারী কর্মচারীর অশোকের বাণী কারুবাকীর দানকে নথিভুক্ত করা প্রমাণ করে যে মহিলাদের সাধারণত শ্রদ্ধার আসনে বসান হত। কিন্তু যখন এই ধরনের উল্লেখ অধীনতামূলক অবস্থানের প্রমাণের পাশাপাশি রাখা হয় তখন সেই মূল্যায়ণকে পুর্ণবিবেচনা করার প্রয়োজন হয়। ঐতিহাসিক দিক থেকে নারী ও পুরুষের মতই সম্প্রদায় ও পরিচয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্বরূপ। এই পর্যবেক্ষণটিকে বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে। এই প্রসঙ্গে থেরিগাথা গ্রন্থটিকে আলোচনার জন্য গ্রহণ করে। বিশ্লেষণ এবং মহিলাদের ভাবমূর্তির পুনঃনির্মাণের ভিত্তি হবে এই সম্পাদিত থেরীগাথা গ্রন্থটি এবং অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

বৌদ্ধরা দুটি মতের প্রচারক যে মহিলাদের কিছু সমস্যা রয়েছে এবং তারাও পুরুষদের মত বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্য নির্বাণ লাভে সক্ষম। ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠার জন্য বুদ্ধের অনিচ্ছুক অনুমতিদানের সুপরিচিত কাহিনীর বিপরীতে রয়েছে প্রাচীন ভিক্ষুণীদের সাফল্যের অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত বিবরণ যা থেরীগাথায় (প্রবীণ ভিক্ষুণীদের গাথা) লিপিবদ্ধ রয়েছে। বৌদ্ধধর্মের সমমনোভাবাপন্ন ধারণা এবং তার পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাসের দ্বন্দ্বের অনুসন্ধান। বিভিন্ন লেখক একজন ধর্মীয় সংস্কারক হিসেবে বুদ্ধের মৌলিক দ্ব্যর্থকতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন যিনি নারীর সামনে সংঘের দ্বার উন্মুক্ত করেও তাদের অবস্থানের অবনতি ঘটিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যেকার শত্রুতাকে প্রতিফলিত পদক্ষেপের সাহসিকতাকে হ্রাস করেছেন। সম্ভবতঃ এই দ্ব্যর্থকতা সামাজিক করে। আটটি কঠোর নিয়ম বা গুরু ধর্ম প্রাচীন বৌদ্ধদের যুগের রীতিনীতির সঙ্গে তাল মেলানোর একটি প্রচেষ্টা হতে পারে। দ্ব্যর্থকতার ধারণার সঙ্গে সমঝোতা করার প্রচেষ্টায় মহিলারা যখন বৌদ্ধধর্মের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছল তখন তারা ক্রমশঃ পুরুষদের সমান হয়ে গেল। এই আদর্শ প্রকাশিত হয়েছে থেরীগাথায় যেখানে নারী অর্হত্ব লাভ করতে পারে বলে দাবী করা হয়েছে।

থেরীগাথায় এমন অনেক নারীর কাহিনী রয়েছে যাদের জন্য বৌদ্ধধর্ম ছিল গভীরভাবে মুক্তিদানকারী ও সন্তোষজনক। এই নারীরা প্রমাণ করেছেন যে নারী বৌদ্ধধর্মের লক্ষ্যপূরণে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম। ১৯৯০ এর দশক ধ্রুপদী বৌদ্ধ রচনা থেরীগাথার একটি পুনঃ পরীক্ষার সাক্ষী। এটি থেরী বা আক্ষরিক অর্থে প্রবীণা মহিলাদের কৃতিত্বদানকারী একটি অনন্য নথি যাঁরা বৌদ্ধ ঐতিহ্যের অভ্যন্তরে ভিক্ষুণীরূপে সম্মানিত। ঊনবিংশ শতকে এটির আবিষ্কারের সময় থেকেই গ্রন্থটি কতখানি মহিলাদের কণ্ঠস্বরকে প্রকাশ করে সেই বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রন্থটিরসপ্রথম অনুবাদকদের (জার্মান) অন্যতম নিউম্যান মনে করেছিলেন যে যদিও গাথাগুলি রচনার কৃতিত্ব মহিলাদের দেওয়া হয় এগুলিকে প্রকৃতপক্ষে পুরুষরাই রচনা করেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম ও লিঙ্গ বিষয়ের অন্যতম ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন, প্রাচীন বৌদ্ধ সমদর্শিতার আদর্শের পক্ষে অধিকাংশ যুক্তিই নির্ভর করে থেরীগাথার মত বিরল নথির উপরে যেটি নারীর ‘বিজয়সঙ্গীত’ লিপিবদ্ধ করে বলে দাবী করা হয়। এমন কোন প্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে বলতে পারি এগুলি সত্যিই মহিলাদের দ্বারা রচিত হয়েছিল কারণ এগুলিকে সংকলন, সম্পাদনা ও শব্দার্থ লিখন করেছিলেন ধম্মপদ নামে একজন ভিক্ষু। পণ্ডিত মিসেস রিজ ডেভিডস যিনি

১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থটিকে ইংরাজী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন প্রতিটি সাহিত্যিক রচনার কৃতিত্ব পুরুষদের দেওয়ার স্পষ্ট ঝোঁকের উল্লেখ করা ছাড়াও বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীতে থেরগাথা ও থেরীগাথার পার্থক্য উল্লেখ করে নিউম্যানের বক্তব্যকে খণ্ড করেছিলেন। ব্ল্যাকস্টোনের মতে থেরীগাথা হল একটি উত্তেজক ও প্ররোচনামূলক গ্রন্থ। যতদূর জানা যায় এটি হল বিশ্বের ধর্মের একমাত্র মূল পালি রচনা যেটি রচনার কৃতিত্ব মহিলাদের দেওয়া হয় এবং যেটি একান্তভাবেই মহিলাদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে।

থেরগাথা ও থেরীগাথায় যথাক্রমে পুরুষ ও নারীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যেভাবে আমাদের ধারণা দিয়েছিলেন সেই পদ্ধতির সূক্ষ্ম পার্থক্যের প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই কারণে মহিলাদের ক্ষেত্রে নির্বাণ লাভকে প্রায়শই একটি বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেটি অধ্যাবসয়ের ফল, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটিকে অপেক্ষাকৃত মসৃণ বলা হয়েছে। এই ভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্ল্যাকস্টোন বলেছেন যে গ্রন্থগুলি নির্বাণ ইচ্ছুকদের পথনির্দেশক গ্রন্থরূপে কাজ করবে বলে আশা করা হয়েছিল। তিনি এ বিষয়টির প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে যে রচনাগুলির পুরুষদের লিখিত মনে করা হয় সেগুলির সুর অপেক্ষাকৃত নৈব্যক্তিক; যেগুলি মহিলাদের দ্বারা লিখিত বলে মনে করা হয় সেগুলিতে রচয়িতার ব্যক্তিগত অর্ন্তভুক্তির পরিমাণ বেশী; এর মধ্যে রয়েছে প্রায়শই বিস্তৃত সামাজিক প্রসঙ্গে অতীত অভিজ্ঞতার উল্লেখ। তিনি স্বীকার করেছেন এই পার্থক্যগুলি সূক্ষ্ম এবং সর্বদা স্পষ্ট নয়। অন্য কথায়, লিঙ্গ পরিচয় তাৎপর্যপূর্ণ একথা নির্দেশ করেও ব্ল্যাকস্টোন ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের যৌথ আধ্যাত্মিক ও পার্থিব জগত সম্পর্কে স্পর্শকাতর।

থেরীগাথা তার বর্তমান রূপে একটি দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের সৃষ্টি। রচয়িতাদের অনেককে বুদ্ধের সমসাময়িক রূপে সনাক্ত করা হয়েছে, কয়েকটি গাথার প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে কয়েকটি আবার সম্ভবতঃ পরবর্তীকালে সংযুক্ত হয়েছে। এটি সংকলন ও গাথাগুলির সঙ্গে জীবনীমূলক তথ্য দেওয়ার যুক্তিসসেই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে কিছু অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে থাকে যেটি গ্রন্থটি রচনা করতে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্ল্যাকস্টোনের বিশ্লেষণ আক্ষরিক পাঠের সীমানা অতিক্রম করে মহিলাদের আপাত স্বতঃস্ফুর্ত কণ্ঠস্বর শোনার এবং গ্রন্থটিকে লিঙ্গ সম্পর্কের আরও জটিলতর উপস্থাপন করার সম্ভাবনারূপে দেখে। এগুলি পুরুষকেন্দ্রিক কল্পনা মহিলাদের উপস্থাপন নয়। তাই একথা মনে ধরে নিতে পারি যখন আমরা গাথাগুলি এবং তাদের ভাষ্য থেকে নারী (এবং পুরুষ) এর সত্ত্বা খুঁজে বের করতে পারি, এগুলি হল সেই মূর্তি যেগুলিকে বিভিন্ন ঐতিহ্য থেকে গ্রহণ ও একত্রিত করে মূল পালি সাহিত্য কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

থেরীগাথায় যে গাথাটি রচনা করার কৃতিত্ব ভদ্দা কুণ্ডলকেশা ও পুণ্নাকে দেওয়া হয়েছে সেটি এর একটি উদাহরণ। ভদ্দা ছিলেন সেই স্বল্প সংখ্যক নারীদের অন্যতম যিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে বিকল্প ঐতিহ্য ও আচার অনুষ্ঠান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। ভাষ্যটিতে সংকলিত তাঁর ইতিহাস লোককাহিনীর সংমিশ্রণ। তিনি একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু একজন ডাকাতকে ভালবেসে তাকে বিয়ে করেন। ডাকাতটি তাঁর অলঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যেতে চায় এবং তিনি তাকে উঁচু পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং তার ফলে ডাকাতটি মারা যায়। এরপর বাড়ি ফিরে যেতে না পেরে তিনি পরিব্রাজিকার জীবন গ্রহণ করেন এবং একজন বিখ্যাত তার্কিকে পরিণত হন। যিনি নগরের প্রবেশদ্বারের বাইরে একটি শাখা পুঁতে দিয়ে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তর্কে অংশগ্রহণকারী পণ্ডিতদের সেটি ভেঙ্গে ফেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর দাবীকে উপস্থাপন করতেন। শেষপর্যন্ত প্রখ্যাত ভিক্ষু সারিপুত্ত তাঁকে বিতর্কে পরাজিত করেন। ভদ্দার গাথা থেরীগাথায় দেখি এবং সেখানে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে তাঁর জীবন সম্পর্কে লিখেছেন, “তিনি একটি মাত্র পোশাক পরে ঘোরাফেরা করতেন, তিনি মুণ্ডিত মস্তক, ধুলি দ্বারা আবৃত ছিলেন এবং দেখলেন ভিক্ষুরা বুদ্ধের বন্দনা করছে। তিনিও বিনীতভাবে তাঁর সামনে নত হলেন। বুদ্ধ তাঁকে ডাকলেন ও দীক্ষাদান করলেন। তারপর পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, কাশীতে ভ্রমণ করে ভিক্ষা করে বেঁচে রইলেন এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচার করলেন।

অপরদিকে পুগ্গা হলেন একজন দাসী মহিলা যিনি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জল তুলতে গিয়েছিলেন, যেহেতু তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তাঁর মণিব তাঁকে প্রহার করবেন অয্যং দণ্ডভয়ভীত। তাঁর গাথা একজন ব্রাহ্মণের সঙ্গে সংলাপের আকারে নির্মাণ করা হয়েছে যিনি প্রতিদিন সকালে স্নান করতে নদীতে আসতেন। তাঁর পাপ ধোওয়ার জন্য যখন তিনি নদীতে ডুব দিচ্ছিলেন তখন তিনি কাঁপছিলেন। পুরা যুক্তির দ্বারা তাঁকে এই কাজে বিরত করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন মাছ ও কচ্ছপরা মুক্তিলাভ করে কিনা বা জলে তাঁর পুণ্য ও ধুয়ে যাবে কি না।

তিনি বললেন :

জল আনতে আমি নদীতে যাই

প্রহারের ভয়ে এমনকি শীতকালেও,

মণিবের ক্রুদ্ধ বাক্যে অপমানিত হয়ে,

ব্রাহ্মণ তুমি কীসে ভয় পেয়েছ

যে তুমি নদীতে যাচ্ছ?

তুমি কাঁপা কাঁপা হাত পায়ে কেন ঠাণ্ডা সহ্য করছ?

 

ব্রাহ্মণের এই উত্তর শুনে যে তিনি তাঁর পাপ ধুয়ে পুণ্যে সঞ্চয়ের চেষ্টা করছেন, পুণ্য উত্তর দিলেন,

এখন ব্রাহ্মণ কে তোমায় বলল যে এই জলে ধুলে তুমি কুকর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে?

কেন, তাহলে কি মাছ এবং কচ্ছপরা

এবং যারা জলে থাকে তারা সোজা স্বর্গে যায়?

কিন্তু জল তোমার পুণ্যকে ধুয়ে দেবে

তুমি সমস্ত কিছুকেই হারারে

এখানেই যুদ্ধ করবে এবং কাঁপবে

কিন্তু তুমি যদি তা না কর।

তাহলে তোমরা চামড়া বরফের হাত থেকে বাঁচবে না।

 

শেষপর্যন্ত ব্রাহ্মণ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং ঘোষণা করলেন যে এতদিন পর্যন্ত তিনি শুধুমাত্র ব্রহ্মবন্ধু ছিলেন এবং এখন একজন প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয়েছেন। পুন্না একটি জাতি হিসেবে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব ও একচেটিয়া অধিকারের ধারণা অসার প্রমাণ করেছেন। তিনি একজন দাসী ছিলেন কিন্তু এই ঘটনায় তাঁর মণিব এত খুশি হয়েছিলেন যে তিনি তাকে মুক্তি দান করলেন এবং তাঁর অনুরোধে সংঘে প্রবেশ করলেন।

ঠিক যেমন বুদ্ধের ভিক্ষু সংঘের দুই প্রধান শিষ্য ছিলেন সারিপুত্ত ও মোল্লান, ঠিক একইভাবে তিনি দুজন নারীকে তাঁর শিষ্যাদের মধ্যে প্রধান বলে গণ্য করেছিলেন এঁরা হলেন উপ্পলবগ্না ও ক্ষেমা। ক্ষেমা নামটির অর্থ হল শান্ত এবং স্থির এবং এটি নির্বাণের সমার্থক শব্দ। ক্ষেমা মগধ রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি রাজা বিম্বিসারের মহিষী হন। কিংবদন্তী অনুসারে, বেনুবনবিহারে তিনি স্বয়ং বুদ্ধের দ্বারা শিক্ষালাভ করেন এবং তৎক্ষণাৎ অর্হত্ব অর্জন করেন। এরপর তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির জন্য খ্যাতি লাভ করেন এবং বুদ্ধ স্বয়ং তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন। এবং জেতবন বিহারে আর্যদের রুদ্ধদ্বার কক্ষে একটি আসন তাঁকে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ক্ষেমা তাঁর সঙ্গিনী বিজয়াকেসনিয়মকানুন শেখান যাতে করে তাঁর মন পুনর্জন্ম সম্পর্কে উদ্বেলিত হয় এবং তিনি সংঘে শান্তি খুঁজতে বাধ্য হন।

পটাচারা ছিলেন শ্রাবস্তীর এক ধনী ব্যবসায়ীর সুন্দরী কন্যা। তিনি তাঁর পিতামাতার অমতে বিয়ে করেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর স্বামী সন্তান ও পিতামাতা সকলকেই হারান। তিনি দুঃখ থেকে অব্যহতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ভিক্ষুসংঘে যোগ দিয়েছিলেন। পটাচারা সম্পর্কে বুদ্ধ বলেছিলেন যে তিনি ভিক্ষুণীদের মধ্যেসবিনয়ের প্রধান রক্ষক। তিনি মানুষের দুঃখ সম্পর্কে গভীরভাবে অবহিত ছিলেন। এই কারণে পটাচারা ছিলেন ভিক্ষু উপালির নারী সংস্করণ। কেন তিনি বিনয়ের নিয়মকে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে বসিয়েছিলেন তা বোঝা সহজ কারণ তাঁর পূর্বের উশৃঙ্খলতার ফলাফল তার কাছে ততদিনে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সংঘে তিনি এই শিক্ষা পেয়েছিলেন যে নিয়মকানুনের গভীর অধ্যয়ন প্রয়োজনীয় এবং পরিশোধনকারী এবং এর সঙ্গে আসে আত্ম সংযমের নিরাপত্তা, তিনি ভাল থাকার ফলে আত্মতুষ্ট, এবং দুঃখের ফলে উদ্বিগ্ন ও বিভ্রান্ত না হতে শিখেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি মানুষের দুঃখ সম্পর্কে গভীর বোধ লাভ করেন এবং তার সহবিহারীভিক্ষুণীদের সাহায্যকারিণী হয়ে ওঠেন। সমস্যায় পড়লে যাঁরা তাঁর কাছে আসতেন তাঁদের তিনি সাহায্য করতেন। ভিক্ষুণী চন্দ্রা বলেছিলেন যে পটাচারা তাঁকে করুণার সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন এবং তাঁকে মুক্তিলাভ করতে সাহায্য করেছিলেন। অপর ভিক্ষুণী দ্বিতীয় উত্তরা বলেছিলেন কেমন করে পটাচারা একদল ভিক্ষুণীর কাছে আচরণ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে বলেছিলেন :

মনকে প্রতিষ্ঠা করে

উত্তরা পটাচারার কথা মনে রাখলেন এবং বললেন :

যখন আমি এই কথাগুলি শুনলাম—

পটাচারার উপদেশ

আমার পা ধুয়ে

আমি একাকী বসলাম।

 

এইভাবে এই ভিক্ষুণী তিনপ্রকার বিদ্যা, প্রকৃত জ্ঞান ও নির্বাণ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ‘থেরীগাথা’য় থেরীদের প্রতি পটাচারার নির্দেশও সেই নির্দেশ পালন করার সুফল লিপিবদ্ধ রয়েছে।

শস্য আছড়ানোর লম্বা লাঠি নিয়ে

যুবকেরা শস্য আছড়ায়,

এইভাবে তারা তাদের শিশু ও স্ত্রীদের খাওয়ায়;

এইভাবে যুবকেরা তাদের সম্পদ লাভ করে,

একইভাবে বুদ্ধের শিক্ষাকে অণুসরণ করলে

কোন অনুশোচনা হয় না।

দ্রুত পা ধুয়ে

তুমি একাকী বসে পড়।

নিজেকে মনের শান্তিতে নিয়োজিত কর,

এবং বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে কাজ কর।

যখন তারা পটাচারার

এই নির্দেশ শুনল

তখন তারা পা ধুয়ে

একাকী বসল।

নিজের মনকে শান্ত করতে নিয়োজিত হল।

এবং এইভাবে তারা বুদ্ধের শিক্ষাকে অনুসরণ করল।

রাত্রির প্রথম যামে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ল,

রাত্রির মধ্যযামে স্বর্গীয় নয়ন পরিশুদ্ধ হল

রাত্রির শেষযামে তারা দুঃখকে ছিন্ন করল।

উঠে তারা তার পায়ের সামনে নত হল,

তারা তাঁর নির্দেশ পালন করেছে;

আমরা তোমাকে শ্রদ্ধা করব

ইন্দ্রের ত্রিশটি দেবতার মত

যুদ্ধে অপরাজিত।

আমরা তিনগুণযুক্ত,

এবং আমাদের সমস্ত পাপ ধুয়ে গিয়েছে।

 

পটাচারা পাঁচশজন মহিলাকে সংঘে নিয়ে এসেছিলেন। মহাপ্রজাপতির নেতৃত্বে যে সমস্ত মহিলা পার্থিব জীবন ত্যাগ করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছয়। সে সমস্ত মহিলারা সমস্যায় পড়তেন তাঁরা গৌতমীর কাছে না গিয়ে পটাচারার কাছে আসতেন কারণ তিনি একজন মহান শিক্ষিকা ছিলেন। তিনজন মহিলা মহাপ্রজাপতি, পটাচারা এবং ধম্মদিন্না (ধম্মদিনা দুজন নারীকে অর্হত্ব লাভে সাহায্য করেছিলেন, এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মহাপ্রজাপতির অন্তেবাসিকা) প্রচারিকা হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাত এবং মহিলাদের বৌদ্ধ সংঘে গ্রহণ করে তিনি তাঁদের সুখলাভের পথ দেখিয়েছিলেন। এখানে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এই যে মহিলাদের একজন মহিলার দ্বারা ধর্মঅন্তকরণ ছিল বৌদ্ধ ধর্মে তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শিক্ষিকা হিসেবে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছিলেন যার ভিত্তি ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র ও ইতিহাস। কিন্তু তাঁর শ্রোতাদের কাছে আত্মার ক্ষণস্থায়িত্ব, আধ্যাত্মিক শান্তির কাছে আত্মসমর্পণ বা বুদ্ধের ইচ্ছা পালন করা সেটিই অধিকতর আবেদনময় হোক না কেন তাঁরা মূলতঃ একই শিক্ষা দিয়েছিলেন।

আই. বি. হর্ণার মন্তব্য করেছেন, একজন মহিলা যে এমন কথা উচ্চারণ করেছেন তার থেকে প্রমাণিত হয় যে হিন্দুত্বের প্রাচীন ধারণা যে নারী শুধুমাত্র সন্তানের জন্মদাত্রী এবং পণ্য তখনও ধ্বংস হয়ে না গেলেও ইতিমধ্যেই তারষবিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। এটি অস্বাভাবিক নয় যে এই আবেদনের সূত্রপাত হয়েছিল একজন নারীর মধ্যে থেকে কারণ তারা সর্বদাই অন্তরালে ছিল। তবে, বাহ্যিকভাবে ধর্মের উপর তাদের প্রভাব যতই নগণ্য বলে মনে হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদের বিরাট প্রভাব ছিল, তারা এটিকে প্রভাবিত করেছিল যেহেতু তারা এর মধ্যে ছিল, তাদের যে কোন বিষয়ে সক্রিয় আগ্রহ ছিল। এবং বাস্তবে তাদের স্বামীদের যে কোন মতবাদকে তারা প্রভাবিত করত।

থেরীগাথা অনুসারে বুদ্ধ প্রায়শই ভিক্ষুণী এবং গৃহী নারীদের প্রত্যক্ষ ও যথাযথভাবে অত্যন্ত করুণা ও দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষা দিতেন। তিনি তাদের সাফল্য ও উদারতার জন্য উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। সাহিত্য থেকে আমরা বৌদ্ধ নারীদের দু’প্রকার জীবনের কথা জানতে পারি, একটি ভিক্ষুণী জীবন ও একটি গৃহী রমণীর জীবন। মনে হয় থেরীগাথা হল সেই বিবরণী যেগুলি নারীরা নিজেরা রাখতেন এবং যখন ভিক্ষুরা ধর্মশাস্ত্র সংগ্রহ ও সম্পাদনা করলেন তখন এগুলি কোনভাবে পালি ধর্মসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই গ্রন্থটি ছাড়া প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক বেশী সীমাবদ্ধ হত কারণ ভিক্ষুদের রক্ষিত বিভিন্ন বিবরণীতে ভিক্ষুণীদের কাহিনীকে তেমন বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে, সাফল্যে এবং ধর্মবোধে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে মহিলাদের বৌদ্ধ সংঘে যোগ দেওয়ার কোন বাধা ছিল না। মহিলাদের কাহিনী যে ধর্মশাস্ত্রগুলিতে তেমন একটা প্রচারলাভ করেনি তার কারণ হল সেই সমস্ত পণ্ডিতদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব যাঁরা এগুলিকে রচনা করেছিলেন। থেরীগাথা না থাকলে আমরা ভিক্ষুণী সংঘ সম্পর্কে জানতে পারতাম না বিশেষতঃ যেহেতু স্বয়ং বুদ্ধ এই বিষয় দ্ব্যর্থক। যে বিবরণী ভিক্ষুরা রচনা করেছিলেন তাতে ভিক্ষুণীদের তুলনায় গৃহী নারীদের কথাই বেশী জানা যায়।

ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি যে গৃহী নারীরা প্রায়শই নেতিবাচকভাবে চিত্রিত হতেন যারা তাদের স্বামীদের ফিরে পেতে চাইতেন বা পুরুষের কাছে কোনরকম বাধা সৃষ্টি করতেন। এই ধরনের নারীর কাহিনী ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী কারও কাছেই আকর্ষণীয় নয় এবং তাদের কণ্ঠস্বর সম্ভবতঃ চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পুরুষদের বিবরণীতে আরেকধরনের নারীর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন ধার্মিক গৃহী নারী শিক্ষার্থী যাঁদের কাহিনী প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে সবচেয়ে ভালভাবে পাওয়া যায়। ন্যান্সি ফ্রাংক দেখিয়েছেন বৌদ্ধ কাহিনীর মহাথেরী ভিক্ষুণী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সকলের প্রত্যাশামত মহাপ্রজাপতি গৌতমীষনন একজন বিখ্যাত বণিকের কন্যা বিশাখা যিনি বৌদ্ধ আদর্শের অনুশীলন করতেন এবং কখনও ভিক্ষুণী ধর্ম গ্রহণ করেননি। তাঁর কাহিনী থেকে বৌদ্ধ সাহিত্যের দুটি বিষয়বস্তুর কথা জানা যায়—ধর্মে গৃহীদাতাদের গুরুত্ব এবং ইতিবৃত্ত রচয়িতাদের সংসার ত্যাগকারীদের তুলনায় এই ধরনের নারীদের অধিক গুরুত্ব প্রদান।

থেরীগাথায় তিন ধরনের নারীর সম্পর্কে আলোচনা পাই। প্রথম প্রকারের নারী ছিল তারা যারা ভাবত সংঘের জীবন তাদের সংসার জীবনের দুঃখ কষ্টের মধ্যে আশ্রয় দেবে। দ্বিতীয় প্রকারের নারী ভিক্ষুণী জীবনে প্রবেশকে আশীর্বাদ বলে মনে করত। তারা মনে করত যে এটি আত্ম উপলব্ধির একটি মন্ত্র এবং মানসিক সক্রিয়তার বৃহত্তর ও পূর্ণতর একটি ক্ষেত্র যা সাংসারিক বৃত্তের তুলনায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের নারী কখনও প্রচারমূলক আদর্শে উদ্দীপিত হয়নি বা পারিবারিক জীবনের তুলনায় ভিক্ষুণী জীবনের সুবিধার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। তারা কেবল বোধি জ্ঞানলাভের বাসনার দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিল কারণ ধর্মীয় জীবনকে তারা তাদের মূল লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেছিল। তারা ভিক্ষুণী জীবনকে সেই জীবন থেকে পলায়ন বলে ভাবেনি যা তারা সহ্য করতে পারছে না, তারা জানত যে তারা এই জীবন যাপন করতেই সবচেয়ে পছন্দ করবে, এবং তাদের মতে এই জীবনই তাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত ছিল। অতীতকেন্দ্রিক কোন আবেগ তাদের পারিবারিক জীবন থেকে সন্ন্যাস জীবনে পাঠায়নি, বরং ধর্মীয় আহ্বান, এমনকি একটি সম্পদ লাভের আহ্বান যা পার্থিব জীবনে লাভ করা সম্মানের তুলনায় বেশী গৌরবময়। ধর্মীয় জীবন যে মূল্য দাবী করে তা হল ত্যাগ, কিন্তু ত্যাগ হল একটি সুবিধা যেখানে স্বাধীনতা, অর্ন্তদৃষ্টি এবং শান্তি লাভ করা যায়। তৃতীয় শ্রেণীর নারী সংঘে যোগ দিয়েছিলেন ধর্মের অনুপ্রেরণায়। সুমেধা এসেছিলেন তাঁর ইন্দ্রিয়ের সুখের প্রতি বিরাগ এবং ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ থেকে। তিনি হলেন উপরোক্ত দুই শ্রেণীর মহিলাদের একটি সেতু সদৃশ।

সুমেধা তাঁর বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংঘে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি যখন সংঘে প্রবেশ করতে না দিলে আত্মহত্যা করবেন এই ভয় দেখালেন তখন তাঁরা তাঁকে নিষেধ করতে পারলেন না। সুমেধা ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মহিলা যিনি ঘোষণা করেছিলেন।” আমার কর্তব্য বাড়ির মধ্যে নয়। “তিনি রাজপরিবার থেকে আগত তাঁর পানিপ্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করে চুল কেটে ধ্যান অনুশীলন করলেন।

পরবর্তীকালে তিনি জ্ঞানী ও বিখ্যাত হলেন, এবং তাঁর পিতামাতা, পানিপ্রার্থী এবং তার অনুগামীদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করতে সক্ষম হলেন। এখানে সংসারত্যাগ ও বিবাহের মধ্যে পছন্দকে একটি সুন্দর উপমা হিসেবে দেখানো হয়েছে।

থেরীগাথার কয়েকজন ভিক্ষুণীদের গাথায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্থির করে দেওয়া দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার প্রতি অসন্তোষ চোখে পড়ে। এগুলি থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে পারিবারিক জীবনের বাইরের জগতের সঙ্গে মহিলাদের একাত্মভাব আগ্রহ খ্রীঃ পঃ ৬ষ্ঠ শতক থেকে অস্তিত্বশীল ছিল। এটি পাশ্চাত্যের প্রভাবে ঘটেনি—এটি ছিল পুরুষতান্ত্রিক কাটামোর বাইরে মহিলাদের নিজের পরিচয়ের একটি দেশীয় ও প্রাচীন অন্বেষণ। এমন অনেক মহিলা ছিলেন যাঁরা স্ত্রী হিসেবে। চিরাচরিত ভূমিকা পালন করতে করতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। এমন মহিলাদের দৃষ্টান্তও রয়েছে যারা শিলনোড়ার একঘেয়েমি থেকে মুক্তিকে উদযাপন করেছিলেন। নিম্নলিখিত গাথায় সুমঙ্গলের মা তাঁর অনুভূতিকে প্রকাশ করেছিলেন :

“নারী, তুমি মুক্ত হও

আমি কত মুক্ত

রান্না ঘরের একঘেয়েমি থেকে কত মুক্ত।”

 

থেরীগাথায় চিরাচরিত প্রথার বিরোধিতা দেখতে পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উভয় প্রকার স্বাধীনতার ধারণাই এখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এইশকবিতাগুলিতে নারীরা পুরুষের অধীনস্থ এবং তার উপর নির্ভরশীল এই ধারণারশবিরোধিতা রয়েছে। মুত্তা বলেছে—

আমি মুক্ত, সম্পূর্ণ মুক্ত

তিনটি কুৎসিৎ বস্তু থেকে

আমার হামানদিস্তা, আমার শিলনোড়া আর আমার

কুঁজওয়ালা স্বামীর থেকে

আমি জন্ম ও মৃত্যু থেকে মুক্ত।

 

উমা চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন “ভিক্ষুণীদের মুক্তিকে বিকাশলাভ ওষমনঃসংযোগের সুযোগ হিসেবে দেখা হয়েছে। বুদ্ধের যুগে একমাত্র ভিক্ষুণী হিসেবেই নারী তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সমাজের নিয়মের হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে পারত।”

জ্ঞানান্বেষণই এই সমস্ত নারীকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী করে তুলেছিল। ভদ্দা কুণ্ডল কেশা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একজন চোরের সঙ্গে তাঁর প্রেমের ব্যর্থতা এবং বুদ্ধিতে তাঁর সমতুল্য কাউকে খুঁজে না পেয়ে জৈন সম্প্রদায়ে যোগ দেন। তর্কে জৈনদের হারিয়ে এবং তাদের কাছ থেকে আর কিছু শেখার নেই দেখে তাদের পরিত্যাগ করেন এবং তাঁর বৌদ্ধিক বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য বৌদ্ধদের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করতে চান। অন্য একজন নারী নন্দুত্তরা যিনি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার পর তাঁর বৌদ্ধিক চাহিদার মুক্তিকে মহামোগ্নল্লানের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করে খুঁজে পেলেন। তাঁর উপদেশে নন্দুত্তরা ভিক্ষুণীসংঘে যোগ দিলেন।

থেরগাথায় ভদ্দা কপিলানীর স্বামী তাঁর কথা বলেছেন এবং থেরীগাথায় তিনি নিজে তাঁর নিজের কথা বলেছেন। তাঁর স্বামী কাশ্যপ স্থির করেছিলেন যে তাঁর পিতামাতা যতদিন জীবিত আছেন ততদিন তিনি তাঁদের সেবা করবেন এবং তারপর সংঘে প্রবেশ করবেন। কাশ্যপের পিতা মাতার মৃত্যুর পর তিনি ও ভদ্দা দুজনে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে, মস্তক মুণ্ডন করে, ভিক্ষুর বেশ পরে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে পরস্পরের থেকে পৃথক হলেন। তাঁরা দুজনেই অর্হত্ব লাভ করে বৌদ্ধ সংঘের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। বুদ্ধের অতীত জীবনের কাহিনী, স্মরণ করার ক্ষেত্রে ভদ্দা প্রথম স্থানেই ছিলেন। থেরীগাথায় তিনি তাঁর নিজের ও তাঁর স্বামীর কৃতিত্বকে উদযাপন করেছেন, এবং তাঁদের যৌথ অর্ন্তদৃষ্টির কথাও বলেছেন—

আমরা দুজনেই দেখেছি, তিনি ও আমি, পৃথিবীর করুণা ও দুঃখকে, এবং অতিক্রম করে গিয়েছি আমরা দুজনেই আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে অর্হত্ব লাভ করেছি আমরা দুজনেই শীতল হয়েছি, দুজনেই নির্বাণ লাভ করেছি।

স্পষ্টতঃই নারী ও পুরুষ ত্যাগেরও জগতে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে। রিটা গ্রস বলেছেন যে “থেরীগাথা সেই সমস্ত মহিলাদের কাহিনী যাঁরা বৌদ্ধধর্মের বার্তাকে সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করে তার শান্তি ও মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছেছেন সমস্ত যুগের বৌদ্ধদের কাছে একটি শিক্ষা যে মহিলারা কতখানি অর্জন করতে পারে।”

হর্ণার দেখিয়েছেন যে “থেরগাথার তুলনায় থেরীগাথায় প্রকৃতি চেতনার প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়। প্রথমটিতে এই বিষয়ে অনেক উল্লেখ থাকলেও দ্বিতীয়টিতে কম রয়েছে। তবে এটি এই কারণে নয় যে মহিলারা প্রকৃতির দ্বারা পুরুষদের তুলনায় কর্ম প্রভাবিত হন, কারণ আমরা প্রায়ই এমন মহিলাদের কথা জানতে পারি যারা প্রকৃতিকে ভালবাসে। প্রকৃতপক্ষে ধ্যানের সময় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন, এবং ইচ্ছাশক্তির জোরে সমস্ত বিঘ্নসৃষ্টিকারী শব্দ ও দৃশ্যকে নির্মূল করে দেন। তাঁরা সেই বন্ধনগুলিকে ছিন্ন করে ফেলেন যা তাঁদের সংসারের আবর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মুহূর্তটি ও তার প্রকাশ সমস্ত ধরনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চিত্রকল্প থেকে মুক্ত।”

এই নারীরা ইন্দ্রিয়কে শৃঙ্খলিত করতে পেরেছেন এবং এই কারণে মুক্তিলাভের ভিক্ষুণী সংঘে ২৪ জন রাজপরিবার থেকে প্রবেশ করেছিলেন যাদের মধ্যে তিনজন বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলেন। এঁরা হলেন ভিক্ষুণী সংঘের বিখ্যাত  প্রতিষ্ঠাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী, ক্ষেমা ও বুদ্ধের অপর জ্ঞাতি মহিলা কিসা গোতমী যিনি যাঁরা রেশমী চীবর পরিধান করতেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন।  চৈনিক বৌদ্ধ মহিলাদের প্রসঙ্গে মার্জারি উলফের যুক্তিকে গ্রহণ করছি সেখানে তিনি বলেছেন যে মহিলারা এমনভাবে ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারতেন যা  পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গ সমতা আদর্শে স্বীকৃত ছিল না।

বণিক পরিবার থেকে তেরজন মহিলা এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে ধম্মদিনা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রচারিকা হয়েছিলেন এবং তাঁকে ধম্মকথিকা বলে মনে করা হত। পটাচারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ আচার্য্যা ও বিনয়ে পারদর্শিনী।

থেরীগাথায় উল্লিখিত অন্তত ১৮ জন ভিক্ষুণী ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তর্গত ছিলেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ভদ্দা কপিলানী, নন্দুত্তরা, শকুলা ও সুন্দরী। এর কারণ হতে পারে হিন্দুত্বের মধ্যে নির্বিচারবাদ ও কঠোরতার অভাব যার ফলে মহিলাদের মধ্যে নতুন ধর্মীয় ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই কারণে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় থেকে বহু সংখ্যক মহিলার সংঘে প্রবেশ করাটা মোটেই আশ্চর্যজনক ছিল না।

অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে চারজন মহিলা এসেছিলেন এবং অন্তত এগারজন মহিলা রয়েছেন যাঁদের জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় না। পতিতা শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন চারজন, বিমলা, অর্দ্ধকাশি, অভয়ের মা এবং সবচেয়ে বিখ্যাত আম্রপালি যিনি দেহের নশ্বরতা ও অর্থহীনতাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভিক্ষুণীসংঘ সেই সমস্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে একটি সম্মানজনক ও সুগম পথ উন্মুক্ত করেছিল যারা তাঁদের বৃত্তিকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একবার সংঘে প্রবেশ করলে   তাঁদের কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতে হত।

সংঘে প্রবেশ কোনভাবেই সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল ছিল না, এবং খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের মধ্যেই মুক্তির ধারণা সমাজের সমস্ত স্তরের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্লেটোর দর্শনের মত কারও একচেটিয়া সম্পদ ছিল না, বরং ছিল এমন একটি বস্তু যা সকলেই বুঝতেই পারত এবং লাভ করতে চেষ্টা করত।

মহিলারা ছিল তিন প্রকারের বিবাহিত, অবিবাহিত ও বিধবা। বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে পিতামাতা বা স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হত। সাধারণভাবে পণ্ডিতদের ধারণা ছিল যে প্রাচীন ভারতবর্ষে এটা ভাবা অসম্ভব ছিল যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে অগ্রাহ্য করে এবং চিরাচরিত সামাজিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে নারী সংসার বহির্ভূত জীবনযাপন করতে পারবে। পিতৃতন্ত্রের প্রাধান্য নাকি ভিক্ষুণী জীবন গ্রহণে ইচ্ছুক মহিলারা সত্যিই সাংসারিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অর্হত্ব লাভের জন্য উৎসর্গীকৃত হতে পারেন এটি দেখার ইচ্ছা কোনটি বৌদ্ধসংঘকে ভিক্ষুণীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে উৎসাহিত করেছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

কুমকুম রায়ের পর্যবেক্ষণ মতে, থেরীগাথায় মহিলাদের রূপ কিছুটা আলাদা। এর কারণ হতে পারে এই যে এই গ্রন্থটির লক্ষ্য ভিক্ষুরা কম (যাঁদের কাছে নারীদেহের বিভিষিকার উল্লেখই যথেষ্ট ছিল) এবং গৃহী পুরুষ ও নারীরাই বেশী ছিল। এই ধরনের পাঠকদের মধ্যে সফল হতে গেলে একচেটিয়া একঘেয়ে রূপকে ভাঙতে হবে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য দ্বারা এবং এটিই থেরীগাথার বৈশিষ্ট্য। অ্যালান মনবার্গের মতে নারী বিদ্বেষ, বৌদ্ধধর্মের নিয়তি ছিল না। শুধুমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে নয় অনুশীলনকারী ও আচার্য্যা হিসেবেও মহিলা বা প্রাচীন বৌদ্ধধর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্বেও তাদের পুরুষদের সমান আধ্যাত্মিক মর্যাদাযুক্ত বলে মনে করা হত। থেরীগাথাকে এই ধরনের কয়েকজন মহিলার আধ্যাত্মিক সাফল্যের কাব্যিক শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপের পাঠ করা হয়। যাঁরা সন্ত বা অর্হৎ হয়েছিলেন। রাজা বিম্বিসারের রাণী ক্ষেমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল, তিনি তাঁর ধার্মিক স্বামীর বহু পূর্বেই অহত্বলাভ করেছিলেন। এমনকি কেউ যদি এই সমমনোভাবাপন্ন সূচনাকে স্বীকার করে নেয় তাহলে এই বিপরীত প্রবণতা এবং মহিলাদের প্রতি বৌদ্ধদের ক্রমবর্ধমান কঠোরতারও ছিল যা সামাজিক কারণ থেরীগাথা সেই পথের একটি বর্ণনা যার মাধ্যমে মহিলারা পুরুষ ও মহিলার অসম সম্পর্ককে প্রত্যক্ষ করে পারিবারিক ভূমিকার বাইরে একটি পরিচয়কে লাভ করতে চেয়েছিল।

যতদিন পর্যন্ত থেরীগাথা আলোচনা হয়নি ততদিন পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মে মহিলাদের ইতিহাস বা কাহিনীকে একটি অপেক্ষাকৃত সরলরৈখিক পদ্ধতিকে উপস্থাপন করা হয়েছে; নির্যাতন থেকে স্বাধীনতায় পরিবর্তন, প্রগতি ও মুক্তির একটি পরমকারণবাদী কাহিনী তথাকথিত হীনযান থেকে মহাযান বা অভিজাত আদর্শ থেকে অধিকতর উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক আদর্শ। তবে রিটা গ্রস এর মতে উপযোগিতাও সীমাবদ্ধ। এই সমস্ত মহিলারা বীরাঙ্গনা কিন্তু তারা একটি “থেরীগাথায় বর্ণিত মহিলাদের কাহিনী অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিন্তু তাদের পুরুষতান্ত্রিক অতীতের প্রতীক। বীরাঙ্গনা ও আদর্শ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানা ও তাদের উদযাপন করা প্রয়োজন কিন্তু তাদের ন্যায়সঙ্গতভাবে যতটুকু প্রাপ্য তার থেকে বেশী দিয়ে ক্ষতিপূরণ না দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।” উমা চক্রবর্তীর মতে “পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভূমিকার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মহিলাদের উপলব্ধির কিছু প্রাথমিক প্রকাশ আমরা ভিক্ষুণীদের রচিত থেরীগাথার কবিতাগুলিতে দেখতে পাই।” এগুলি একথা স্পষ্ট করে দেয় যে মহিলাদের ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিসরের বাইরে আত্মপরিচয়ের সন্ধান আমাদের খ্রীঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতকে নিয়ে যায়। পাশ্চাত্যের প্রভাবযুক্ত সমালোচকরা এটিকে পাশ্চাত্যের প্রভাব বলে। দাবী করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি পিতৃতান্ত্রিক পরিসরের বাইরে আত্মপরিচয়ের একটি অত্যন্ত দেশীয় ও প্রাচীন অনুসন্ধান। এই কবিতাগুলিতে মহিলারা রন্ধনশালার একঘেয়েমি এবং স্বামীদের অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির কথা বলেছে। তারা নিজেদের জন্য সেই পরিসরের কথাও বলেছে যেটি তারা পেয়েছে সংঘে প্রবেশ করে আত্ম সচেতনতা অনুশীলনের মাধ্যমে।

রিটা গ্রসের মতে, “যখন সমগ্র বৌদ্ধ ইতিহাস জুড়ে মহিলাদের ভূমিকা ও মূর্তিকে বৌদ্ধধর্মের নারী পুর্ণমূল্যায়ণের একটি অংশ হিসেবে দেখা হয়, তখন একটি নিখুঁত অতীতের অনুসন্ধান ব্যবহারযোগ্য অতীতের অনুসন্ধানের সঙ্গে মিশে যায় এবং পরস্পরকে উন্নত করে। পুরুষতান্ত্রিকতার ত্রুটি বিচ্যুতি সঙ্গে যুক্ত একটি নিখুঁত বিবরণী দুটি জিনিস খুব স্পষ্টভাবে দেখায়। এটি প্রমাণ করে যে মহিলারা বৌদ্ধ আলোচনায় বিভিন্নভাবে ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে অংশ নিয়েছেন এবং তাদের ভূমিকা বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে প্রায়শই আলোচিত হয়েছে। অপরদিকে, সমস্ত বৌদ্ধ ইতিহাস জুড়ে মহিলাদের ভূমিকাকে বিশেষভাবে দেখলে অতীতের পুরুষতান্ত্রিকতার দুর্বলতাগুলি স্পষ্ট হবে”। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ও ভিক্ষু জীবনের ইতিহাস বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মানসিকতা ও সমসাময়িক সামাজিক মূল্যের প্রভাবকে প্রকাশ করে।

রিটা গ্রসের গ্রন্থটির আলোচনা করতে গিয়ে ইয়ান অ্যাপলে মন্তব্য করেছেন, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিশ্চিতভাবেই একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যখন একদিকে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের শালীনতার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হত আবার অন্যদিকে সংঘকে কোন পুরুষ আধিপত্যের বাইরে একটি স্বয়ংশাসিত মহিলা গোষ্ঠীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব (অবশ্যই অকল্পনীয়তা এর সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হত। ভিক্ষুদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত হয়ে ভিক্ষুণীরা কোন প্রত্যক্ষ ক্ষতির কারণ না ঘটিয়েই সংসার জীবন ত্যাগ করার সুবিধাকে ভোগ করতে পারতেন।

মহিলাদের প্রতি সমাজের মানসিকতা ও আচরণ যার ফলে এই ধরনের সুরক্ষার প্রয়োজন হয়েছিল সেটি বোঝা সহজ, কিন্তু এই ধরনের নীতি গ্রহণের জন্য সংঘের সমালোচনা করা অনুচিত। কিন্তু এখানে বৌদ্ধধর্মের সমমনোভাবাপন্ন আদর্শ ও তার পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসের পরস্পরবিরোধিতাটিকে অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য ছিল এই পরস্পরবিরোধিতাকে ঐতিহাসিকভাবে ব্যাখ্যা করে এই পরিস্থিতিকে বৌদ্ধধর্মের একটি ভবিষ্যৎ ও প্রকাশের সংশোধন। এই ধরনের পুর্নগঠন বৌদ্ধধর্মের বর্তমান প্রতিষ্ঠানিকরূপ এবং তার দার্শনিক গঠনের বর্হিপ্রকাশ বা সাযুজ্য রক্ষিত হবে।

উমা চক্রবর্তী মতে, সংঘে প্রবেশ মহিলাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার দিত যার মাধ্যমে তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ন্ত্রণ থেকে আংশিকভাবে মুক্তিলাভ করতে পারত। বৌদ্ধ সংঘে প্রবেশের সময়ে একজন ভিক্ষুণীকেও নিম্নলিখিত শপথটি গ্রহণ করতে হত, “আমি আসার থেকে অনাগারিক জীবনে প্রবেশ করছি এবং ভগবান শাক্যমুনিকে অনুসরণ করছি। আমি একজন গৃহীর অগভীর বৈশিষ্ট্যকে পরিত্যাগ করছি।’ অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে বুদ্ধ নারীকে পুরুষের তুলনায় নিকৃষ্ট মনে করতেন এবং তাদের সংঘে প্রবেশের অধিকার দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। মহিলাদের সংঘে প্রবেশাধিকার দিলে তা সংঘের পবিত্রতা ও শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করবে এই ধারণা পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল কিন্তু এই ধারণা বুদ্ধের জীবন দশর্নের সঙ্গে খাপ খায় না। বার্থলোমিউজের এই মত বুদ্ধের কথপোকথন থেকে বোঝা যায় যে তিনি ভিক্ষুণী সংঘে প্রতিষ্ঠা করতে অনিচ্ছুক থেকে থাকতে পারেন, কিন্তু তা সত্বেও তিনি এটিকে আর প্রচারিত ধর্মের এক অবশ্য প্রয়োজনীয় সহায়তা বলে মনে করতেন’ সত্যি বলেই মনে হয়। পেলা ভার্মা দেখিয়েছেন যে “বুদ্ধ যদি মহিলাদের সংঘে যোগ দেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করেও থাকেন তাহলে তার কারণ পুরুষের তুলনায় নারীর নিষ্ক্রিয়তা যতটা না ছিল সামাজিক বিধিনিষেধ ও সংঘের বাস্তব প্রয়োজন তার থেকে বেশী ছিল। মহিলাদের সংঘে গ্রহণ করতে বুদ্ধের অনাগ্রহ সম্ভবত এই সামাজিক চিন্তার প্রতিফলন ছিল যে তারা সংঘে প্রবেশ করলে পরিবার বিপন্ন হবে এবং সংঘের জীবন আরও জটিল হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, মহিলাদের সংঘে প্রবেশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সামাজিক চিন্তার জগতের অন্তর্গত ছিল এবং এটিকেও বিবেচনা করার প্রয়োজন ছিল। একজন ভিক্ষু ও একজন ভিক্ষুণী পরস্পরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সংঘের দুর্নাম হবে এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবতঃ পরবর্তী বৌদ্ধ জ্ঞান বৃদ্ধ স্থবিরগণ এই ধরনের কঠোর নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছিলেন। শেষতঃ একটি পুরুষশাসিত সমাজে যেখানে ক্ষমতাসীন ভিক্ষুরাই সংখ্যাগরিষ্ট ছিলেন, সেখানে এই নিয়মগুলি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বিরুদ্ধে বেশী কাজ করবে।

মহিলাদের প্রতি বৌদ্ধ মানসিকতা সম্পর্কে ধারণার ভিত্তি হল মূলতঃ সংঘ ও তার সদস্যদের কাজকর্ম, সমগ্র সমাজের কাজকর্ম নয়। কিন্তু বৌদ্ধ সংঘের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করায় সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেখানে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুন প্রধান সামাজিক রীতিনীতিকে অমান্য করলে পুরুষদের স্বাভাবিক ও মহিলাদের ব্যতিক্রম মনে করত। ভিক্ষুণী সংঘ গঠনে আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বিধি নিষেধ আরোপের মাধ্যমে নারীদের সংঘে প্রবেশ অনুমতি প্রদান করেছিলেন। বলতে গেলে বুদ্ধের ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যার মাধ্যমে আপামর ভাগ্যহীনা নাট্যদের মুক্তির বারতা উদ্‌ঘোষিত হয়েছিল।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn