
বীর মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী
৪ মার্চ তার অন্তর্ধান দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা
জুবায়ের সিদ্দিকী
আজকের সূর্যোদয় অনলাইন।। চট্টগ্রামে নিতান্ত একজন সাধারণ মানুষ হয়েও নিজের চরিত্র, জীবনদর্শন ও কর্মগুণে এক অনন্য সাধারণ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব মরহুম মীর রমজান আলী। দীর্ঘদিন সমাজের একজন সংগঠক, সমাজ সেবক, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি সি এন্ড এফ ব্যবসায়ী হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করলেও অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখক ছিলেন। আজকের সুর্যোদয়ের নিয়মিত কলামিষ্ট মীর রমজান আলী ২০১২ সালে ৪ মার্চ চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকালের অল্প কিছুসময় আগে ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পবিত্র রমজান মাসে তাঁর জন্ম। বাবা-মা মরহুম মীর আহসান আলী ও মরহুমা আয়জুন্নেসা খাতুন তখন তাঁদের সদ্যজাত পুত্রের নাম রেখেছিলেন রমজান।
বৃহত্তর ঢাকার অন্তর্গত অধুনা মুন্সিগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুর অঞ্চলের শ্রীনগর থানার বিশ্ববিশ্রুত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু খ্যাত রাডিখাল ইউনিয়নভুক্ত দামলা গ্রামের অভিজাত, ঐতিহ্যবাহী ’মীর বাড়ি’র ধারা মেনে ’রমজান’ এর আগে যুক্ত ’মীর’ এবং সম্ভবত পিতৃনামের অনুসরণে শেষাংশে যুক্ত হল আলী, যার ফলে বলা বাহুল্য তার পুরো নামটি হয়ে দাঁড়াল-মীর রমজান আলী।
তিনি তাঁর পিতা-মাতা’র ৯ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। রমজান সাহেবের নানা বাড়িও এই দামলা গ্রামেই, ডিপটি (ডিপুটি) বাড়ি নামে যা পরিচিত। মীর বাড়ি ও ডিপটি বাড়ি দুই-ই সম্পদে, সম্মানে, আভিজাত্যে শিক্ষা-দীক্ষায় এলাকায় অগ্রণী ভুমিকা পালন করে আসছে।
মীর রমজান আলীর ছয় সহোদর ভ্রাতার মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ মরহুম মীর আহমদ আলী, তারপর মরহুম আমানত আলী এবং ছোট তিন ভাই মীর লায়েক আলী, মীর কোরবান আলী ও মীর হায়দার আলী প্রত্যেকেই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং আছেন। তিন সহোদরা মরহুম আনোয়ারা খাতুন, আকতার বানু ঝিনু, মাহমুদা বেগম রিনা প্রত্যেকেই সুগৃহিনী ও স্ব-স্ব সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং আছেন।
রমজান সাহেব ঢাকার অধুনালুপ্ত, স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোগোজ স্কুল থেকে মেট্রিক, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে আই.এ এবং নারায়নগঞ্জের তোলারাম কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। পুরনো ঢাকার ২৫/১ বাহাদুর লেনে তাদের পৈত্রিক বাড়ি এবং ফরিদাবাদে রমজান সাহেবের নিজবাড়ি রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৮ এপ্রিল ২৬ বছর বয়সে তিনি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার যশোলদিয়া জমিদার বাড়ির ডা. গাজী আবুল কাশেম (চুন্নু গাজি)’র দ্বিতীয় কন্যা ডা. রওশন আরা আক্তার (নাজমা)’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
কিন্তু বিয়ের ২১ বছরের মাথায় ১৯৯৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সামান্য একটি টিউমার-এর অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগে ভুলের কারনে তার সহধর্মিনীর দু:খজনক অকালমৃত্যু ঘটে।
মীর রমজান আলীর আরেকটা বড় পরিচয় হলো তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কর্মজীবনের বাইরে মীর রমজান আলী নিজেও অত্যন্ত সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। সামাজিকভাবে বিভিন্ন পর্যায় বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করেন এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জীবনাচার, বলতে গেলে এটাই তার আসল পরিচয়। ১৯৭৮ সালে লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকান্ডে প্রবেশ করেছিলেন। মীর রমজান আলীর এক কন্যা ফেরদৌস জাহান (রিমা) ও একমাত্র পুত্র মীর নাজমুল আহসান রবিন।
মীর রমজান আলীর দুটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে প্রবন্ধটি ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে ঘিরে স্মৃতিচারণ বই ’স্মৃতির দুয়ারে তুমি’ (প্রকাশ কাল ১৯৯১) এবং দ্বিতীয় বই তার প্রয়াত স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ’কেমন আছো জানতে ইচ্ছে করে’ (প্রকাশকাল ১৯৯৭) প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও ‘মাইজভান্ডার শরীফ : ঐশি প্রেক্ষিত’ নামে একটি বইয়ের প্রকাশক ছিলেন।
মীর রমজান আলী ’৭১ এর আগে ও পরে দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ হলেও পীর মুরশিদের মাজারের প্রতি আকর্ষণ ছিল তার আমৃত্যু। তাঁকে দাফনও করা হয়েছে নগরীর আরেক আউলিয়া হযরত মিশকিন শাহ (রহ:) এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে।
অত্যন্ত সদালাপী ও সাদামাটা জীবনের অধিকারী মীর রমজান আলী আজকের সূর্যোদয়ের নিয়মিত পাঠকও ছিলেন। তিনি আজকের সূর্যোদয়ের কলামিষ্ট হিসেবে আজকের সুর্যোদয় চট্টগ্রাম অফিসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। একদিন অফিসে হযরত আমানত শাহ (র:) ওরশ উপলক্ষে তবারুক নিয়ে আসেন। আমার সহকর্মীদের সাথে বসে খেলেন এবং খাওয়ালেন।
মীর রমজান আলী ইউনেস্কো ক্লাবস ও লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানী, থাইল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন। বিশিষ্ট এই সংগঠক মীর রমজান আলীকে নিয়ে একবার সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গেলে তিনি বলেন,‘ওয়া রমজান আলী আঁরে ইউনেস্কোর মেম্বার গরিবা না’। রমজান আলী হেসে বললেন, ‘অবশ্যই মেয়র মহোদয়।’
এরপর রমজান আলীকে নিজ হাতে খাওয়ালেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আতাউর রহমান খান কায়সার, ইসহাক মিয়া ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে, ঢাকায় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা সাজেদা চৌধুরী, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আমির হোসেন আমু, মো. নাসিম, মোজাফফর হোসেন পল্টু, মোস্তফা মহসিন মন্টু ও ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক ছিল এই মানুষটির।
সাংবাদিক সমাজের মধ্যে খোন্দকার মোজাম্মেল হক, গিয়াস কামাল চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, এ বি এম মুসা, এরশাদ মজুমদার, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া, মতিউর রহমান চৌধুরী, শফিকুর রহমান প্রমুখের সাথে ছিল সখ্যতা।
তিনি চট্টগ্রাম বেতারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও দীর্ঘসময় কাজ করেন। আজকের সূর্যোদয় এর প্রধান সম্পাদক প্রায় তারই সমান বয়েসি খোন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে তারা ছিলেন ঘনিষ্ঠ।
তিনি চট্টগ্রামে এক আড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে খোন্দকার মোজাম্মেলকে সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিশেষ সংবর্ধনা প্রদানসহ ইউনেস্কো ক্লাব পুরস্কারে ভূষিত করেন।
অত্যন্ত কর্মঠ ও প্ররিশ্রমি এই মানুষটি সারাজীবন মানুষের উপকার ও সংগঠন করে গেছেন। মীর নাজমুল আহসান রবিন তার বাবা রমজান আলীর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কলামগুলোকে একই মলাটে আবদ্ধ করে ’মীর রমজান আলীর রচনা সমগ্র’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে।
২০১২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী বিকেলে ঘুম থেকে জেগেই হঠাৎ করে বমি করতে শুরু করেণ মীর রমজান আলী। দ্রুত তাঁকে নেওয়া হয় চট্টগ্রামের স্বনামধন্য সিএসসিআর হাসপাতালে। সেদিনই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে পৌঁছে যান তিনি। ১লা মার্চ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে। ৪ ঠা মার্চ এর প্রথম প্রহর রাত ১.৪০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। মীর রমজান আলীর স্মৃতির প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।