
সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির নিয়ম থাকলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি) তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপিসির অন্তত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন একই পদে বহাল থাকায় প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর একই কার্যালয়ে কিংবা একই শাখায় চাকরি করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ যুগ পার করে দিয়েছেন এক চেয়ারেই। কিন্তু এদের বদলির কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না অদৃশ্য কোন কারণে বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। বিপিসির কর্মীরা মনে করেন, একই পদে বছরের পর বছর থাকার কারণে ক্রমাগত দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অন্তত তিন বছর পর পর বদলি হওয়ার কথা থাকলেও কিন্তু কোনো কোনো কর্মকর্তা একই বিভাগে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছেন। এদের কেউ কেউ বদলি হলেও তদবির করে আবার ফিরে আসছেন। ফলে একদিকে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে ওইসব কর্মকর্তার উপর বিপিসি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যখনই এদের বদলির প্রসঙ্গ আসে, তখনই বলা হয় এরা এই কাজে দক্ষ; এদের বদলি করলে সংস্থা বিপাকে পড়বে। বিপিসি কর্মীরা মনে করেন, বদলি না হওয়ায় জুনিয়র কর্মকর্তারা দক্ষ হয়ে গড়ে উঠছেন না। শুধু বিপিসি নয়, বিপিসির অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা, যুমনাতেও বছরের পর বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই কর্মস্থলে থাকার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিপিসির অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার একটি তালিকা গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে এসেছে। এ তালিকার সবাই একই বিভাগে বছরের পর বছর ধরে চাকরি করছেন। এদের একজন মণিলাল দাশ, যিনি অর্থ বিভাগে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি বিপিসির অধীনে থাকা আরেকটি কোম্পানির সিও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ মণি লাল দাশের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিপিসিতে তিনি দূর্ণীতির মহারথী হিসেবেও পরিচিত।
মো ইউসুফ হোসেন ভূইয়া ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় সাত বছর ধরে। উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন বাণিজ্য ও অপারেশন বিভাগে কাজ করছেন প্রায় ১৪ বছর যাবৎ। প্রায় ১৪ বছর ধরে বণ্টন ও বিপণন বিভাগে উপমহাব্যবস্থাপক পদে আছেন মোহাম্মদ মোরশেদ হোসাইন আজাদ। উপমহাব্যবস্থাপক মো. শাহরিয়ার মোহাম্মদ রাশেদ হিসাব বিভাগে কাজ করছেন আট বছরের বেশি সময় ধরে। হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এটিএম সেলিম আছেন সাত বছর যাবৎ। উপমহাব্যবস্থাপক সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির হোসেন ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন হিসাব বিভাগে। সাধারণ কর্মশাখায় ব্যবস্থাপক হিসেবে মো. মিজানুর রহমান কর্মরত আছেন প্রায় ১১ বছর। সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান হিসাব বিভাগে কাজ করছেন ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে। সহকারী ব্যবস্থাপক মো. নুরুল ইসলাম অর্থ বিভাগে কাজ করছেন প্রায় ১৬ বছর।
বণ্টন ও বিপণন বিভাগে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ইউডিএ সাধন চন্দ্র বসু। হিসাব বিভাগের রেকর্ড কিপার মো. শাহেদুল আলম (ইউডিএ) এক অফিসে কাজ করছেন সাড়ে ১২ বছর। একই শাখায় প্রায় ১১ বছর কাজ করছেন ক্যাাশিয়ার (ইউডিএ) জান্নাতুল ফেরদাউস ও স্টোর কিপার নিজাম উদ্দিন। লাইব্রেরিয়ান রিফাত আরা ইসলাম কাজ করছেন ১০ বছর যাবৎ। বাণিজ্য ও অপারেশন বিভাগে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন মো. নুর উন নবী, সংস্থাপন শাখায় প্রায় ১২ বছর ধরে আছেন কৃষ্ণা পাল, বিপণন বিভাগে প্রায় ১১ বছর ধরে কাজ করছেন জান্নাত আরা (এলডিএ)। এ ছাড়া আরও অন্তত দুই ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, যারা একই শাখায় বা দপ্তরে অন্তত ৫ থেকে ৮ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিপিসির চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের যুক্তিসঙ্গত কারণে বছরের অধিকাংশ সময় ঢাকায় অফিস করতে হয়। মাঝে মধ্যে চট্টগ্রামে যান মিটিং করতে। সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে বিপিসিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বদলি কম হয়। ফলে একই পদে বছরের পর বছর অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী আছেন, কাজ করছেন এটা সত্য। অনেকে একই শাখায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে কাজে দক্ষ হয়ে উঠছেন। ফলে বদলি কম হয়। তবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বদলি হওয়ার প্রয়োজন। বদলি হলে জুনিয়র কর্মীরা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারবেন।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকা বা বদলি হওয়ার বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’
উল্লেখ্য, বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মো. শামসুর রহমান তার সময়কালে একবার বদলি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানান। সে সময় কিছু বদলি করা হলেও পরে সেই উদ্যোগ থেমে যায়।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী তিন বছর পর যে কাউকে কর্তৃপক্ষ চাইলে বদলি করতে পারে। এটার মূল উদ্দেশ্য হলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা। এছাড়া কেউ যেন একই জায়গায় থেকে দুর্নীতি করতে না পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, তবে আমরা বিপিসি বা অন্যান্য কোম্পানির কর্মকর্তা- থাকে, তাহলে যুক্তি কী সে বিষয়েও জানতে চাইব।