বুধবার - ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২২শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাস ও করণীয়

নতুন করে সাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ তৈরি হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এ জন্য আবহাওয়া অধিদফতরের সামুদ্রিক সতর্কবার্তা শুনা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ মে) দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব অমিত দেব নাথ স্বাক্ষরিত আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা যায়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’আরো উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ১৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
এ সংবাদের পর উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগ অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সংবাদ পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজনদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ‘মোখা’র ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। প্রবল শক্তিশালী এ ঘূর্ণিঝড়টি বেশকিছুদিন থেকে সাগরে অবস্থান করছে। রাজনৈতিক সামাজিক ও পেশাজীবি প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইতিমধ্যে ‘মোখা’র ক্ষয়ক্ষতির মোকবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পৃথিবীর নানা দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাসের কবলে পড়েছে। ব্যাপকভাবে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্রমেই এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে মানবজাতির সাংঘর্ষিক কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতির বিরুপ প্রতিক্রিয়া দিন দিন বাড়ছে। মানবীয় সভ্যতা সমাজ থেকে ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে। সভ্যতার নামে মানব সমাজে সবক্ষেত্রে মানবতা বিধ্বংসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির নিয়মনীতি প্রতিনিয়ত মানবজাতি ভঙ্গ করছে। ফলে পৃথিবীর ওপর নানা সময় অসময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। মানবসমাজ একে অপরের প্রতি জুলুম অত্যাচার নির্যাতন অন্যায়ভাবে চালাচ্ছে। সৃষ্টির সেরা মানবজাতি সৃষ্টিকর্তার আদেশ নির্দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান দিন দিন বাড়ছে। এসব কারণে পৃথিবীর ওপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারী আসে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের মন্তব্য।

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় সাগরে। তাই সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এর শিকার হয়। পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৮০টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। তবে এগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। যেগুলো উপকূল বা স্থলভাগে আঘাত হানে সেগুলো ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস বলছে, সমুদ্রতীরবর্তী বহু দেশ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড়কে বলা হয় হারিকেন, চীনে টাইফুন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাইক্লোন।

ইতিহাসের সূত্র ধরে একের পর এক প্রাকৃতিক দূর্যোগ সঙ্গী হয়ে থাকে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ব-দ্বীপ। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টিসহ নানা দূর্যোগ হানা দেয় এই দেশে। বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশেও বেশ বড় বড় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে।

১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় (ভোলা সাইক্লোন):

১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর চট্টগ্রামে আঘাত হানে এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি। বিশ্ব ইতিহাসের ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয়। এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। সেই সময় ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। হিসাব অনুযায়ী ১৯৭০ সালের প্রবলতম ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। যাদের মধ্যে ১ লাখই ছিল জেলে। বেশির ভাগই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এছাড়া অসংখ্য গবাদিপশু এবং ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এই সাইক্লোনটি সরাসরি বরিশালের মাঝখান দিয়ে উঠে আসে। ভোলাসহ অনেক এলাকা পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৭০ এর ঘূর্ণিঝড়।

১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়:

বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ২৯শে নভেম্বরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী। এই ঝড়ের ফলে দেশে যে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৫ হাজার ৭০৮ জন মানুষ প্রাণ হারায়। ঝড়ে সেবার প্রায় ৭০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন।

১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়:

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ২৯-৩০শে এপ্রিলে সংগঠিত হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়কে ‘শতাব্দীর প্রচ-তম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগের সাইক্লোটির কারণে ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। বাস্তুহারা হয়ে পড়েন ১ কোটিরও বেশি মানুষ। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়গুলো ২/৩ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয় না। কিন্তু এই সাইক্লোনটি ছয় ঘণ্টা ধরে স্থলভাগে আসে এবং তা-ব চালায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটি মানুষ।

২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর:

২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঝড়টিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। তুলনামূলক কম মানুষ মারা গেলেও এই ঘূর্ণিঝড়ে অবকাঠামোগত অনেক ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। রেডক্রসের হিসাবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও সরকারিভাবে ছয় হাজার বলা হয়েছিল।

২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা:

২০০৯ সালের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা। এই ঝড়ের বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। বলা হয়, বাংলাদেশে আঘাত হাত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘৭০ ও ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে।

এছাড়া বাংলাদেশের উপর বয়ে যাওয়া উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়:

বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড়- ১৮৭৬ সালের পহেলা নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি অনেকের কাছে বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ২ লাখ মানুষ, যখন ১০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়।

১৯৬০ সালের ৩১শে অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল। ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে পহেলা অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়

২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস এর পূর্বাভাস দেওয়া হলেও পরে তা বার্মার উপকূলে আঘাত হানে। মিয়ানমারে এর প্রভাবে বহু ক্ষতি হয়।

২০১৩ সালের ১৬ই মে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় ‘মাহাসেন’’

২০১৫ সালের ৩০শে জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে ৫-৭ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’

২০১৬ সালের ২১শে মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’

২০১৭ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’।

২০১৯ সালের মে মাসের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ আঘাত হানে। যার বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ উঠেছিল ২৫০ কিলোমিটার। তথ্যসূত্র: বিবিসি

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn