
“পৌণ্ড্রীক ভাষাই বাংলা ভাষা”
এস আই ওবায়দুল
পৌণ্ড্রীক মানে আখ, চিনি বা মিষ্টি। প্রাচীন পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্র থেকেই পৌণ্ড্রীক শব্দটির উৎপত্তি৷
প্রসঙ্গত, ভাষা একটি রহস্যময় বিষয়ের নাম। তবে, ভাষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপারটি হলো- জন্মগতভাবে ভাষা খুবই পরিবর্তনশীল। সৃষ্টি থেকে বর্তমান অবধি এটি তার খোলস পরিবর্তন করে ব্যাপক ভিত্তিক রুপ বদলের পর সমসাময়িক ভাষা হিসেবে পরিগ্রহ লাভ করেছে। অতঃপর, ভবিষ্যতেও এটি ক্ষণে ক্ষণে তার স্বরুপ পরিবর্তন করে নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি করবে; এটাই অনুমিত বাস্তব। অর্থাৎ, সময়ের সাথে ভাষার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া৷
প্রসঙ্গত, যেকোনো একটি ভাষার প্রধানত দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি হলো কথ্যরুপ এবং দ্বিতীয়টি তার লেখ্যরুপ। আমি কোনো ভাষাবিধ বা এবিষয়ে কোনো গবেষক নই। তবুও বাংলা ভাষার জন্মজন্মান্তরের অথেনটিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে ভাষা/বিভিন্ন বিষয়ের আজীবন এক ছাত্র আমি। সুবাদে, বাংলা ভাষার জন্মকথা/সারবৃত্ত জানতে বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বৈদিক, সংস্কৃত, আর্যভারতীয়, পালি, মাগধী, দেবনাগরী থেকে শুরু করে ব্রাহ্ম লিপি, গুপ্তলিপি, সৌন্ধম লিপি/মতান্তরে সত্যম লিপি থেকে আধুনিক বাংলা আদর্শলিপির ইতিহাসের খোঁজে প্রাচীন ভাষাবিধ পাণিনি, সত্যঞ্জলী, সুনীতি বাবু, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে ডঃ নিহার রঞ্জনসহ হাল আমলের হুমায়ুন আজাদ ও ডঃ মোহাম্মদ আমীন (যদিও ডঃ মোহাম্মদ আমীন এবং তার শুদ্ধবানান চর্চা শুবাচ এর সাথে আমার ব্যক্তিগত মতবিরোধ রয়েছে) রচিত বহু সংখ্যক গ্রন্থ/পুস্তক পাঠে বাংলা ভাষার প্রকৃত পরিচয় সংক্রান্ত সামান্য যে ধারণাটুকু লাভ করেছি- তারই আলোকে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা’র জন্মকথা বা ইতিবৃত্ত শিরোনামে আজকের এই লেখাটি প্রকাশের প্রয়াস আমার…
যাইহোক, বাংলা ভাষার উৎপত্তিগত ইতিহাস জানতে হলে সর্বপ্রথমে আমাদেরকে প্রাচীন ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক মানব ইতিহাস জানার প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে, উপমহাদেশীয় প্রাচীন মানব ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে- সুপ্রাচীনকালে বঙ্গসহ প্রাচীন ভারতে গৌড়, পুণ্ড্র, সমতট ও হরিকেল অঞ্চলে অনার্য নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস ছিল এবং তারা তাদের নিজেদের মধ্যে বঙ্গ ও গৌড় প্রাকৃত ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান বা কথাবার্তা চালিয়ে যেতো। পরবর্তীতে, ইউরোপ/ইরান থেকে আর্য জাতিগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করলে আর্যরা তাদের নিজেদের ভাষা বৈদিক (ঋকবেদ) সঙ্গে নিয়ে আসে। অতঃপর, এ অঞ্চলের অনার্য জাতিগোষ্ঠীর উপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করত, প্রাচীন ভারতীয় অনার্যদের উপর বৈদিক ভাষা চাপিয়ে দেয়। অতঃপর, বৈদিক ভাষা কিছুটা সংস্কার করে দখলদার আর্যরা তখন সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ঘটায়৷ কিন্তু, বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা বুঝতে অক্ষম অনার্য ভারতীয়রা তখন নিজেদের প্রাকৃত ভাষাসমূহের সাথে বৈদিক-সংস্কৃত ভাষার অপভ্রংশ রুপ মাগধী প্রাকৃত বা মতান্তরে গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষার সংমিশ্রণে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবে, মাগধী প্রাকৃত থেকে কালে কালে বাংলা, অসমিয়া, ওড়িশা, মৈথিলী, হিন্দি ও ভোজপুরী ভাষার সূত্রপাত ঘটে।
এরুপে বাংলা ভাষার জন্মলাভের পর আজ থেকে প্রায় ১০০০ হাজার বছর আগে সর্বপ্রথম প্রাচীন চর্যাপদ নামে বাংলাভাষার নিজস্ব সাহিত্য/কবিতা সৃষ্টি হয়। পর্যায়ক্রমে, প্রাচীন চর্যাপদ থেকে অভয়ামঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল হয়ে বর্তমানে আধুনিক প্রমিত বাংলা ভাষার সুদৃঢ় ভিত রচিত হয়। তবে, এতকিছুর পরেও ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো- বাংলা ভাষাকে এতটা ঘুরপথে টেনে না এনে বরং এটিকে পৌন্ড্রীক ভাষা বলাটাই বোধ করি শ্রেয়তর হবে৷ কেননা, আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা/স্থান জয় বা দখল করতে পারলেও, প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্রনগর দখল করতে ব্যর্থ হয়। যেকারণে, স্বাতন্ত্র্য একটি দেশ এবং তার নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা পুণ্ড্র প্রাকৃত থেকেই আমাদের এই মিষ্টিমধুর বাংলা ভাষার সৃষ্টি হতে পারে। উল্লেখ্য যে, পৌণ্ড্রীক শব্দের অর্থ হলো- চিনি বা আখ। আর পুণ্ড্র মানে হচ্ছে মিষ্টিমধুর প্রাচীন বাংলা। প্রাচীন বাংলার অনার্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী তথা অস্ট্রিক, নেগ্রিটো, মঙ্গোলয়েড ও ককেসাসদের মুখের ভাষা ছিল গৌড়ীয়/পুণ্ড্র প্রাকৃত। পরবর্তীতে যেটা চর্যাপদে পর্যবসিত হয়। আর সেইসাথে রাজা অশোকের ব্রাহ্মলিপি প্রসূত সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি চর্চা করতে করতেই; আজকের এই বাংলা ভাষার সূত্রপাত ঘটেছে বলে মনে হয় আমার…