
পৃথিবীতে কোন কিছুই তুচ্ছ নয়
শাহিদা আকতার জাহান
পৃথিবীতে ক্ষুদ্র বা নগণ্য বলে আসলে কিছুই নেই। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় জিনিস দিয়ে সুশোভিত করেছেন—কিছু বড়, কিছু ছোট; কিছু মূল্যবান, কিছু কম মূল্যমান। কিন্তু মূল্য কম বলেই কোনো কিছুকে তুচ্ছ বা মূল্যহীন মনে করা কখনোই সমীচীন নয়। সতর্ক অনুসন্ধান ও মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, অনেক তুচ্ছ বস্তু বা মানুষও ধারণ করে অমূল্য রত্নসম সম্ভাবনা। বাহ্যিক চাকচিক্য বা আকর্ষণীয় রূপ কোনো কিছুর প্রকৃত মূল্যায়নের মাপকাঠি হতে পারে না। অন্তর্দৃষ্টি, যুক্তি, ও সুক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমেই প্রকৃত গুণাবলি অনাবৃত হয়।
আল্লাহর কোনো সৃষ্টি-ই অপ্রয়োজনীয় নয়। বাহ্যিক রূপে সাধারণ বা অগোছালো মনে হলেও, অনেক কিছুর ভেতর লুকিয়ে থাকে বিস্ময়কর জ্ঞান, প্রতিভা কিংবা সম্ভাবনা। মানুষ প্রায়শই বাহ্যিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে মনের গভীরতা বা অন্তর্নিহিত শক্তিকে অগ্রাহ্য করে। ফলে সমাজে অনেক প্রতিভা অবহেলিত ও অনাদৃত রয়ে যায়।
নগণ্য বা তুচ্ছ বলে বিবেচিত অনেক জিনিসেই লুকিয়ে থাকতে পারে অমেয় সম্পদ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— ঝিনুকের কথা। বাইরে থেকে একে সাধারণ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে থাকে মুক্তার মতো অমূল্য রত্ন। বিজ্ঞানও প্রমাণ করেছে, অতি সামান্য ও অবহেলিত উপাদান থেকেও আবিষ্কৃত হয়েছে অমূল্য পদার্থ, শক্তি, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা।
এমন অনেক মহান মানুষ আছেন, যারা সমাজে একেবারে তুচ্ছ বা অবহেলিত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। যেমন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর —যাঁর পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল না আর্থিক কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তাঁর সন্তান বিদ্যাসাগর বাংলার সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। তাঁর অবদান শুধু বাংলার গণ্ডিতে নয়, বিশ্বব্যাপী এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে।
বস্তুর অবিনাশিতাবাদ সূত্রে বলা হয়—বস্তুর কোনো বিনাশ নেই, শুধু রূপান্তর ঘটে। উদাহরণস্বরূপ: গাছ থেকে কাঠ, কাঠ থেকে আসবাব, আসবাব পুড়িয়ে আগুন, আর আগুন থেকে তাপ ও শক্তি। এমনকি কাঠ পোড়ানোর পর যে কয়লা পাওয়া যায়, সেটিও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ময়লা-আবর্জনা, গবাদিপশুর মলমূত্র থেকেও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি উৎপন্ন হচ্ছে। তাই এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কোনো কিছুই অবহেলার নয়।
একজন সাধারণ পোশাকে থাকা দরিদ্র মানুষও হতে পারেন মানবিক গুণে ও জ্ঞানে ভরপুর। কেবল বাহ্যিকতা দেখে তাঁকে তুচ্ছ ভাবা ভুল। ঠিকমতো সুযোগ পেলে তিনিও সমাজে রেখে যেতে পারেন অসাধারণ অবদান। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়— “ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।” তাই কোনো কিছু বা কাউকে তার আকার বা অবস্থা দেখে অবহেলা না করে, অন্তর্নিহিত গুণ ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করাই যুক্তিসঙ্গত।
আমরা প্রায়ই দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় আসল সত্যকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই। যাকে তুচ্ছ ভাবি, অবহেলার চোখে দেখি, তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তনের বীজ। বাহ্যিক চেহারা, সামাজিক অবস্থান কিংবা আর্থিক ক্ষমতা কোনো ব্যক্তির বা বস্তুর প্রকৃত মূল্য নির্দেশ করে না। এই পৃথিবী প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছে—ছোট, অবহেলিত, ও অদৃশ্য জায়গা থেকেই উঠে আসতে পারে মহান সৃষ্টির আলো।
সৃষ্টির প্রতি সম্মান, প্রত্যেক প্রাণ ও বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তিকে উপলব্ধি করা এবং সুবিচারই হতে পারে একটি উন্নত ও সহমর্মী সমাজ গঠনের ভিত্তি। তাই এখনই সময়—তুচ্ছ ভাবা বস্তু বা মানুষকে নতুন দৃষ্টিতে দেখা, তাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আবিষ্কার করা এবং সকলের সম্ভাবনাকে সমান মর্যাদায় গ্রহণ করার। সামান্য থেকে অসামান্য হওয়া এক অলৌকিক যাত্রা, আর সেই যাত্রার সূচনা হয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন থেকেই।