
নিউইয়র্কে্র জ্যামাইকায় শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা
নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশি কমিউনিটি অধ্যুষিত কুইন্সের জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত হলো প্রথমবারের মত তিন দিনব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা’। গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় জ্যামাইকার হিলসাইড অ্যাভিনিউ ও ১৬৫তম স্ট্রিটে অবস্থিত ইলহাম একাডেমি স্কুল প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়, যা শেষ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি রোববার রাতে। খবর বাপসনিউজ ।
১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রথমবার অনুষ্ঠিত বইমেলাটি বাংলা ভাষাভাষি লেখক-প্রকাশক ও পাঠকদের সন্নিবেশিত করেছিল। পাশাপাশি প্রতিদিন ছিল সাহিত্য আলোচনা ও কবিতা পাঠের আসর, পুঁথিপাঠ, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, দেশের গান, শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন আয়োজন। নিউইয়র্ক প্রবাসী খ্যাতনামা লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিকরা প্রতিদিনের আয়োজনে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশি কমিউনিটি বিনির্মাণে এসব লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিকদের অগ্রণি ভূমিকা রয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রবীণ সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক মনজুর আহমদ। মেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আজকাল সম্পাদক শাহনেওয়াজ।
বইমেলায় বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল কয়েকটি স্টল, যেখানে মুখরোচক খাবার পাওয়া যেত। খাবারের তালিকায় ছিল বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পুলি এবং অন্যান্য জনপ্রিয় ও প্রচলিত খাবার।
মেলায় সব বয়য়ের মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে স্কুলপড়ুয়া শিশুরাও ছিল। পিতা-মাতার সঙ্গে এসে বইমেলায় থেকে তারা পছন্দের শিশুতোষ ও সায়েন্সফিকশন বই কিনেছেন। বাংলাদেশের মজাদার খাবার কিনে খেয়েছেন এসব শিশুরা।
বইমেলায় একটি স্টলে বাপসনিউজ”র এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ হয় সাংবাদিক ও বিশ্ব পর্যটক হাবিব রহমানের, যিনি তার স্টলে নিজের লেখা ভ্রমণ কাহিনী বিষয়ক প্রায় দশটি বইয়ের সমাহার ঘটিয়েছিলেন। বিশ্বের প্রায় একশত দেশ ভ্রমণ করা এই বিশ্ব পর্যটক জানান, ‘নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটি দিন দিন বড় হচ্ছে। এ ধরনের বইমেলা আয়োজন প্রবাসী লেখকদের লেখালেখিতে নিঃসন্দেহে উৎসাহ জোগাবে এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মানকে আরো বিকশিত করবে। তিনি বইমেলা আয়োজন করায় আয়োজকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করেছিল প্রবাসী বাংলাদেশি সাহিত্যপ্রেমীদের সংগঠন ‘ঊনবাঙাল’। প্রায় এক দশক ধরে সংগঠনটি বাংলাদেশি কমিউনিতে সাহিত্য চর্চা করছে। বইমেলা উপলক্ষে ৮৩ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
ঊনবাঙাল-এর প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট লেখক ও কবি কাজী জহিরুল ইসলাম বাপসনিউজকে জানান, ‘তিন দিনব্যাপী বইমেলায় আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। আমরা আশান্বিত হয়েছি। ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে ‘অমর একুশে বইমেলা’র আয়োজন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য নিউইয়র্কে সর্বস্তরে বাঙালি বইপ্রেমী ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।’
উদ্বোধনী পর্ব : ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেল চারটায় র্যালি পরবর্তী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একুশে বইমেলার কার্যক্রম শুরু হয়। এদিন বিকেলে ‘বইমেলার র্যালি’ জ্যামাইকার ১৬৯ স্ট্রিট ও হিলসাইড অ্যাভিনিউ থেকে শুরু হয়ে ১৬৫ স্ট্রিট ও ৮৭ রোডে মেলাপ্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। এরপর একগুচ্ছ বেলুন উড়িয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন মনজুর আহমদ। এরপর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং একুশ ও জাগরণের গান পরিবেশিত হয় এবং প্রতীকি নির্মিত শহীদ মিনারে অতিথি ও
প্রবাসীরা একে এক ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এসময় প্রধান অতিথি শাহনেওয়াজ, মেলা কমিটির আহ্বায়ক ফখরুল আলম, সদস্য সচিব আহসান হাবিবসহ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মেলা কমিটির কর্মকর্তা, প্রবাসী কবি, লেখক, সাংবাদিক ও সুধীরা উপস্থিত ছিলেন। এদিন মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ মেলায় যোগ নেন।
একুশের বইমেলার বিশেষ আকর্ষণ, লেখকরাই মেলায় স্টল দিয়েছেন, আর পাঠকরা লেখকদের কাছ থেকে সরাসরি বই কিনেছেন, অটোগ্রাফ নিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। এরমধ্য দিয়ে ‘লেখক-পাঠক সংযোগ’ আরো শক্তিশালী হয়েছে বলে আয়োজকদের অভিমত।
মেলায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লেখকদের বইয়ের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের জন্য কয়েকটি স্টল বসানো হয়। প্রবাসী বাংলাভাষীদের মধ্যে এই মেলা বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করে বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। মেলায় কবি-লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম, লেখক-সাংবাদিক সাঈদ তারেক,বাপসনিউজ প্রতিনিধি ও কবি মিজানুর রহমান এবং সাংবাদিক-লেখক হাবিব রহমানের লেখা বই বেশী বিক্রি হয়েছে। বই বিক্রির শীর্ষে ছিল হাবিব রহমানের লেখা বই।
বইমেলার উদ্বোধনী পর্বে ঊনবাঙাল-এর প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম, মেলা কমিটির আহ্বায়ক ফখরুল আলম, সদস্য সচিব আহসান হাবীব প্রমুখ বক্তব্য দেন। আলোচনা, আবৃতি, গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের অনুষ্ঠান রাত নয়টা পর্যন্ত চলে।
এদিনের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে ‘একুশ ও জাগরণের গান’ এবং ‘কাজী জহিরুল ইসলাম রচিত একুশের কাব্যালেখ্য ‘রক্তের দাম দিয়ে কিনেছি মায়ের ভাষা’ পরিবেশিত হয়। এতে সুমন শামসুদ্দিন, দিমা নেফারতিতি, আহসান হাবীব, মুন্না চৌধুরী ও সৈয়দ মাসুদুল ইসলাম টুটুল অংশ নেন। এদিনের বিভিন্ন আলোচনায় আরো অংশ নেন সৈয়দ ফজলুর রহমান, ডা. সজল আশফাক প্রমুখ। সবশেষের সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রবাসের শিল্পী ফারহানা তুলি, সৌভিক রায় চৌধুরী, ঋতুজা, রুমা চৌধুরী, সেলিম ইব্রাহীম ও মিতা হোসেন সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
দ্বিতীয় দিন : একুশের বইমেলার দ্বিতীয় দিনে ২২ ফ্ব্রেয়ারি শনিবার দিনভর ছিল নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেমিনার, আলোচনা, আবৃত্তি, একক বক্তৃতা, স্বরচিত কবিতা পাঠসহ আরও ছিলো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছুটির দিন হওয়ায় এদিন দর্শক সমাগম বাড়ে। বইও বেশ বিক্রি হয়। এদিনের অনুষ্ঠানমালার শুরুতেই সৈয়দ আল আমীন রাসেলের পরিচালনায় ‘আমাদের অভিবাস জীবন’ শীর্ষক সেমিনার এবং রওশন হকের সঞ্চালনায় শিশুদের ছাড়া/কবিতার অনুষ্ঠান ‘ভোরের পাখি’ পরিবেশিত হয়। এরপর সুমন শামসুদ্দিনের সঞ্চালনায় ‘শব্দরণ্যের নিবিড় গহনে’ শীর্ষক স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে প্রবাসী লেখকরা অংশ নেন। এছাড়াও ‘বাংলা কবিতার জনপ্রিয়তা কেন কমে যাচ্ছে?’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা হয়। ‘প্রবাস জীবন-স্বদেশ ভাবনা’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় ডা. মোহাম্মদ হামিদুজ্জামান, অধ্যাপক ড. মোহসীন পাটোয়ারী ও লেখক-সাংবাদিক সাঈদ তারেক অংশ নেন। সঞ্চালনায় ছিলেন ফখরুল আলম।
এদিন ভ্রমণ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘পৃথিবীর পথে পথে’ বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন ভ্রমণ লেখক যথাক্রমে হাবিব রহমান, আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ও কাজী জহিরুল ইসলাম। সঞ্চালনায় ছিলেন জিএম ফারুক খান।
যুগল আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘একান্তে আমরা দুজন’ শীর্ষক পর্বে আবৃত্তি করেন দিমা নেফারতিতি ও আহসান হাবিব। এছাড়াও ‘গুরু শ্রী চিন্ময়ের দ্বিভাষিক কবিতা পাঠ’ আলোচনায় অংশ নেন দিমা নেফারতিতি, যামিনী ইয়ং ও স্বাতী চক্রবর্তী। বই নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান ‘বই-কথা-কও’ অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন ড. আবুল কাশেম, দেওয়ান নাসের রাজা ও আব্দুল্লাহ জাহিদ। সঞ্চালনায় ছিলেন সোহেল হামিদ। আরো ছিলো আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘মুগ্ধ উচ্চারনের সৌরভ’, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ‘প্রচ্ছদের ভেতরে’, ‘আমি কেনো শিল্পের অনুরাগী’ শীর্ষক আলোচনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন ইমাম চৌধুরী ও শেলী জামান খান।
শেষ দিন : একুশে বইমেলার শেষ দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রোববার দর্শক-শ্রোতায় মেলাপ্রাঙ্গণ ছিলো পরিপূর্ণ। আবহাওয়া একটু ভালো থাকায় এদিন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড.নাজমুল হুদাসহ সর্বস্তরের প্রবাসীরা মেলায় যোগ দেন। মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিলো সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক হাসান ফেরদৌসের ‘বুদ্ধিজীবী ও স্বৈরাচার’ শীর্ষক একক বক্তৃতা।
এদিন কনসাল জেনারেল ড. নাজমুল হুদা তার বক্তব্যে বইমেলার সফলতা কামনা করে বলেন, এমন আয়োজন প্রবাসে বাংলা ভাষা ও শিল্প-সাহিত্য বিকাশে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের অনুপ্রাণিত করবে।
বইমেলায় দিনের শুরুতে ‘অভিবাসী ও আমাদের অধিকার’ শীর্ষক সেমিনার সঞ্চালনা করেন কাজী ফৌজিয়া। এরপর ভায়লা সালিনা মির্জার সঞ্চালনায় ছিলো শিশুদের অনুষ্ঠান ‘আমরা সবাই রাজা’। রওশন হকের সঞ্চালনায় ‘শব্দ রণ্যের নিবিড় গহনে’ শীর্ষক স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে প্রবাসী লেখকরা অংশ নেন। রথীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বিশেষ আলোচনার অনুষ্ঠান ‘তোমার আপন হাতের দোলে’-তে অংশ নেন মিতা হোসেন, মুক্তি জহির ও সোহানা নাজনীন। এই পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন এইচ বি রিতা। এরপর ‘শিল্পাঙ্গনের নাটক’ শিরোনামে পরিবেশিত হয় সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এতে অভিনয় করেন শাহরুখ তাসলিম, সোনিয়া পান্না, শফিউল আলম, আহসান উল্লাহ, নুসায়বাহ কবির, স্বপন কবির ও মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। এছাড়াও ছিলো ‘বাংলা নাটকের সেকাল-একাল’, বই নিয়ে আলোচনার অনুষ্ঠান ‘বই-কথা-কও’, একক গান, আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘মুগ্ধ উচ্চারনের সৌরভ’, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ‘প্রচ্ছদের ভেতরে’ এবং ‘নজরুলের রসবোধ’ বিশেষ আলোচনা। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন কাজী জহিরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক সাঈদ তারেক, সাংবাদিক ইমরান আনসারী ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট নূরুল হক। সবশেষে ছিলো সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পী চন্দন চৌধুরী, মরিয়ম মারিয়া প্রমুখ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন আহসান হাবিব, সেলিম ইব্রাহীম ও জেবুন্নেসা জোৎস্না। বইমেলা উপলক্ষে ‘অক্ষর’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়।