মঙ্গলবার - ১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ১৫ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

ধলঘাট সংঘর্ষ, বিপ্লবী এক মায়ের সন্তান হারানোর বাস্তব ইতিহাস ফেরারী মাস্টারদা সূর্যসেন

ধলঘাট সংঘর্ষ, বিপ্লবী এক মায়ের সন্তান হারানোর বাস্তব ইতিহাস ফেরারী মাস্টারদা সূর্যসেন। ব্রিটিশ পুলিশ ও গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছে মাস্টারদা ও সঙ্গীয় বিপ্লবীদের । চট্টগ্রাম শহর থেকে পূর্বদিকে প্রায় ২৫ বা ৩০ কিলোমিটার দুরত্বে সবুজে ঘেরা শান্ত ও মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। সবুজের টানে মন উদাস করা ও বর্ষায় উজ্জীবিত গাছপালায় প্রকৃতিতে স্বস্তির ছায়াভরা পথ ও প্রান্তর। পটিয়া উপজেলা থেকে তখন রেলপথ আর বর্ষাকালে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন বাহন ছিল না বললেই চলে। গ্রামটি বোয়ালখালীর সাথে লাগোয়া। তাই দুই উপজেলার বিপ্লবীরা সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন । তাই গ্রামটি বিপ্লবীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও জালালাবাদ যুদ্ধের পর এই গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়। গ্রামটির নাম ধলঘাট। পুলিশ ক্যাম্পের জায়গাটি আজো ধলঘাট ক্যাম্প নামে পরিচিত। হয়তো অনেকেই জানেন না এই নামের কারণ । বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলা পাশাপাশি হওয়ায় পুলিশ ক্যাম্প হতে উভয় এলাকার বিপ্লবী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নজর রাখার সুবিধার্থে ঐ ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়। রাত বিরাতে বাড়িতে হানা ও পুলিশ ক্যাম্পে এনে সন্দেহের বসে অকথ্য নির্যাতন করা হতো এই ক্যাম্পে। তখন আরেক নরকের নাম ছিল ধলঘাট পুলিশ ক্যাম্প। যুব বিদ্রোহের পর দশ হাজার(১০,০০০) টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো মাস্টারদা’কে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। তৎকালীন সময়ে দশ হাজার টাকা ছিল বিশাল অংকের টাকা। প্রায় দেড় বছর আত্মগোপন করে ছিলেন মাস্টারদা ও নির্মল সেন। ধলঘাট গ্রামেই মৃত নবীন চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী সাবিত্রী দেবী, ছেলে রামকৃষ্ণ ও মেয়ে স্নেহলতা কে নিয়ে বসবাস করতেন । সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য। তাঁদের টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটি বিপ্লবীদের কাছে “আশ্রম“ নামে পরিচিত। মাস্টারদা ও অন্যান্য বিপ্লবীরা প্রায়শ এই বাড়িতে এসে গোপন বৈঠক করতেন এবং বিভিন্ন প্রেরণাদানকারী বইপত্র পড়তেন।
১৩ই জুন ১৯৩২ সাল। এই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন মাস্টারদা, নির্মল সেন , অপূর্ব সেন, ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। জরুরী বিষয়ে আলোচনা করার জন্য প্রীতিলতাকে ও খবর দিয়ে শহর থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিলো। যদিও এটাই ছিল, মাস্টারদা’র সাথে প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাত। সাবিত্রী দেবী বিপ্লবী মহানায়ক ও তাঁর সঙ্গীয় বিপ্লবীদের রাতের খাবাবের ব্যবস্থা করছিলেন। তিনি মেয়েকে অতিথিদের জন্য ডিম আনতে পাশের বাড়ি পাঠান। ঐ বাড়ির কর্তা একজন সরকারী চাকুরে ছিলেন। বাড়ির কর্তা কথায় কথায় জানতে পারেন সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে তিনজন পুরুষ ও এক জন নারী অতিথি এসেছেন, তাঁরা রাতে থাকবেন ও খাবেন। আগে থেকেই বিপ্লবীদের আনাগোনা লক্ষ্য করায়, লোভি ও ধূর্ত গৃহকর্তা পুরুস্কারের টাকার লোভে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীদের অবস্থানের কথা গোপনে ধলঘাট পুলিশ ক্যাম্পে জানিয়ে দেন।
ক্যাম্পের অফিসার ইনচার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন বিপ্লবীদের অবস্থানের খবরটা পান। তিনি ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। পুরস্কার এবং পদোন্নতির আশায় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাতজন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনষ্টেবলসহ রাত প্রায় ৯.৩০টায় দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন। চারিদিক থেকে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেন। ঐ সময়ে মাষ্টারদা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়িটার নীচ তলার রান্না ঘরে ভাত খাচ্ছিলেন। জ্বরে ভুগতে থাকা নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেন রাতের খাবার না খেয়ে উপরের তলায় শুয়েছিলেন। ঐ সময় মাস্টারদা পুলিশের উপস্থিতি আঁচ করতে পারেন। তিনি দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে বলেন “নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে”। প্রীতিলতাকে নিচে নেমে সাবিত্রী দেবী ও তাঁর মেয়ের সাথে থাকতে বলেন। ততক্ষনে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং এস আই মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করেন। নীচতলায় সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান। প্রশ্ন করেন “ঘরে আর কে আছে”? কিন্তু কেউ উত্তর দিলো না। এ সময় পুলিশ ঘরের উপরের তলায় পায়ের শব্দ শুনতে পান। রিভলবার তাক করে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেন দুইটা গুলি ছুড়লে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত। গুলির শব্দ শোনার সাথে সাথেই চারিদিকে থাকা সৈন্যরা প্রচন্ড গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসেন। পুলিশের গুলি বুকে লেগে নির্মল সেন শহীদ হন। প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে নিয়ে মাস্টারদা অন্ধকারে ঘরের পিছন দিক দিয়ে বাইরে চলে আসেন। তিনি কচুরীপানা ভরা পুকুর পাড়ি দেওয়ার জন্য এগোতে লাগলেন। শুকনো পাতার উপর হাঁটার সময় মর্মর শব্দ শুনে সিপাহীরা গুলি চালালে অপুর্ব সেনও শহিদ হন। কোনভাবে মাস্টারদা আর প্রীতিলতা প্রাণে রক্ষা পেয়ে সটকে পড়ে কাশীয়াইশ গ্রামে পাড়ি জমান। এদিকে সংঘর্ষে সে রাতেই ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নিহত হওয়ায় পুলিশের এস.আই মনোরঞ্জন বোস পটিয়ার মিলিটারী ক্যাম্পে গিয়ে আরো ত্রিশজন সৈন্য এবংএকটা লুইসগান নিয়ে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে ফিরে আসেন। লুইসগানের গুলিবর্ষণে বাড়িটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন দলবল নিয়ে এসে সাবিত্রী দেবী এবং তাঁর পুত্রকণ্যাকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেবার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন। কণ্যা স্নেহলতার জবানবন্দিতে আরো তিনযুবক—দীনেশ দাশগুপ্ত, অজিত বিশ্বাস, এবং মনীন্দ্র দাশকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে সাবিত্রী দেবী, তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণ এবং তিন যুবককে বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং সহায়তা করার দায়ে চার বছর কারাদন্ড প্রদান করা হয়। তাঁদের মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন ঐ জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও ডাক্তার মিঃ কাটারিয়া নির্মমতা ও বর্বরতারজন্য কুখ্যাত ছিলেন। জেলের মধ্যে সাবিত্রী দেবীর ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী যক্ষায় আক্রান্ত হন। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বন্দীর মর্যাদা না দিয়ে নাম মাত্র চিকিৎসা দেন ও লোহার ডান্ডাবেরী পরিয়ে দেন। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে,রোগের অসহ্য যন্ত্রনার সাথে লোহার ডান্ডাবেরী বহন করতে করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে।যা সভ্য জগতে যা হওয়ার কথা ছিল না। তাঁর কষ্টের প্রতিটি নিশ্বাসে জেলখানা আশপাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। মা সাবিত্রী দেবী অসুস্থ পুত্রকে দেখার আবেদন ও আকৃতি জানালেও মৃত্যুর পূর্বে সন্তানকে দেখার অনুমতি পাইনি। মৃত্যুর পর যখন সন্তানকে দেখার জন্য আনা হয়েছিলো, তখন মা সাবিত্রী দেবী দেখেছিলেন, লোহার ডান্ডাবেরী লাগানো ছেলের নিথর দেহ।

ব্রিটিশ সূর্য অস্তগামী করার পেছনে সাবিত্রী দেবী ও তাঁর সন্তানের ত্যাগ রয়েছে, রয়েছে করুন ইতিহাস। তাঁদের হয়তো কিছু চাওয়ার নেই, তাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাঁদের সম্মান দেখাতে অবশ্যই পারি। পারি তাঁদের ত্যাগের স্মৃতিগুলো রক্ষা ও প্রজম্মকে জানাতে। ত্যাগ যদি মূল্যহীন হয়, তাহলে কেউ ত্যাগী হতে চাইবে না।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn