
ডিজিটাল যুগে রমজান: প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক
এম এ সবুর
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””” ””””””””””””””””””
রমজান হল আত্মশুদ্ধি, সংযম ও ইবাদতের মাস। এই মাসে মুসলমানরা বেশি বেশি ইবাদত, দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত ও দান-সদকা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। তবে বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে ইবাদতের এই মহিমান্বিত সময়কে আরও অর্থবহ করে তোলা যেমন সম্ভব, তেমনি অসচেতনভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে সময় অপচয়ও হতে পারে। সঠিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রমজানকে আরও ফলপ্রসূ করা সম্ভব, তবে ভুল ব্যবহারে এটি আমাদের ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দিয়েছে, যা রমজান মাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করলে এটি আমাদের ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির সহায়ক হতে পারে।
১. ইসলামিক শিক্ষা ও দাওয়াহ:
বর্তমানে বিভিন্ন ইসলামিক ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ইসলামিক অ্যাপ ও অনলাইন লাইব্রেরির মাধ্যমে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন অনেক সহজ হয়েছে। কুরআনের তাফসির, হাদিসের ব্যাখ্যা, ইসলামিক লেকচার ও দোয়া সংকলন সহজেই পাওয়া যায়, যা রমজানে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চাকে আরও সমৃদ্ধ করে।
২. ইবাদতের সহযোগী:
আজানের সময়সূচি, নামাজের রিমাইন্ডার, কুরআন তিলাওয়াতের অ্যাপ, রোজার নিয়ত ও দোয়া সংক্রান্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম রমজানে নিয়মিত ইবাদতে সাহায্য করে। অনেক অ্যাপ রয়েছে, যা প্রতিদিনের ইবাদত ট্র্যাক রাখতে সহায়তা করে, ফলে আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা আরও সুসংগঠিত হয়।
৩. দান-সদকা ও যাকাত প্রদান:
রমজানে দান-সদকা ও যাকাত দেওয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। অনলাইন ব্যাংকিং ও দান-সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করা যায়। বিশেষ করে নির্ভরযোগ্য ইসলামিক চ্যারিটি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাহায্য পাঠানো সম্ভব, যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. ভার্চুয়াল ইসলামিক কমিউনিটি:
প্রযুক্তির সাহায্যে অনলাইনে ইসলামিক গ্রুপ ও ফোরামের মাধ্যমে ধর্মীয় আলোচনা, দোয়ার মাহফিল ও ইসলামিক প্রশ্নোত্তর সেশন করা সম্ভব। এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি পায় এবং দ্বীন সম্পর্কে জানা ও বোঝার সুযোগ তৈরি হয়।
প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক
প্রযুক্তির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে, যা রমজানে ইবাদতে মনোযোগ ব্যাহত করতে পারে।
১. সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি:
অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউবে স্ক্রলিং করতে করতে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যায়। রমজানে অযথা বিনোদনমূলক ভিডিও দেখা, ট্রেন্ড ফলো করা বা দীর্ঘক্ষণ চ্যাটিং করা ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
২. সময়ের অপচয়:
রমজানে গেমিং, সিরিজ দেখা বা অবান্তর আলোচনায় লিপ্ত হওয়া সময়ের অপচয় করে। এটি আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রযুক্তি যদি আমাদের সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারে, তবে এটি বরং রমজানের বরকত থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
৩. ভুল তথ্য প্রচার ও বিভ্রান্তি:
বর্তমানে অনেক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভুল ইসলামিক তথ্য ছড়ানো হয়, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু ওয়েবসাইট বা ইউটিউব চ্যানেল ভুল ব্যাখ্যা বা বিদআত প্রচার করে, যা ইসলামিক শিক্ষার ক্ষতি করতে পারে। তাই সোর্স যাচাই না করে কোনো ইসলামিক তথ্য গ্রহণ করা উচিত নয়।
৪. অনলাইনে অতিরিক্ত কেনাকাটা ও ভোগবাদী মনোভাব:
রমজানের অন্যতম শিক্ষা হলো সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। কিন্তু ডিজিটাল শপিং প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতার কারণে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় লিপ্ত হন, যা সংযমের বিপরীত। অনলাইনে খাবারের অর্ডার করা, বিলাসবহুল পোশাক কেনা বা অতিরিক্ত ডিসকাউন্টের লোভে প্রয়োজনের বাইরে কেনাকাটা করা রমজানের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে পারে।
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: করণীয় ও বর্জনীয়
রমজানে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্য কিছু করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় অনুসরণ করা প্রয়োজন।
করণীয়:
ইসলামিক অ্যাপ ও ওয়েবসাইট থেকে কুরআন, হাদিস ও ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করা।
সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে গিয়ে ইবাদতের জন্য সময় নির্ধারণ করা।
অনলাইনে দান-সদকা ও যাকাত প্রদান করে মানবতার সেবায় অংশ নেওয়া।
আত্মশুদ্ধির জন্য ইসলামিক অডিও বা ভিডিও লেকচার শোনা।
সময় ব্যবস্থাপনার জন্য নামাজ ও ইবাদতের রুটিন তৈরি করা।
বর্জনীয়:
অপ্রয়োজনীয় ভিডিও দেখা, দীর্ঘসময় গেমিং বা বিনোদনমূলক কনটেন্টে আসক্ত হওয়া।
ভুল ইসলামিক তথ্য শেয়ার করা বা যাচাই ছাড়া গ্রহণ করা।
অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় মগ্ন হওয়া।
অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের কারণে ইবাদত থেকে দূরে থাকা।
উপসংহার
প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, যা রমজানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি আমরা প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করি, তাহলে এটি রমজানের বরকত বাড়াতে পারে এবং আমাদের আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতে সহায়তা করতে পারে। তবে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সময় নষ্ট হতে পারে, যা রমজানের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করতে পারে। তাই মুসলমানদের উচিত প্রযুক্তির ওপর সংযম রাখা এবং রমজানের সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।