
টাঙ্গাইলের তাঁতের ছোঁয়ায় জীবনের বুনন
মধুপুর গড়, লালমাটি আর চরভর পাহাড়ে ঘেরা টাঙ্গাইল শুধু ভূপ্রকৃতিতেই নয়, শিল্প-সংস্কৃতিতেও অনন্য। এ জেলার অন্যতম গৌরবের উৎস তাঁতশিল্প। কালিহাতী, দেলদুয়ার, গোপালপুর, নাগরপুর, ভূঞাপুর, সখিপুর এবং সদর উপজেলার বল্লা, রানধুনী, হাজরাপাড়া, কাঞ্চনপুরসহ বহু গ্রামে আজও বুনে চলেছে তাঁতের সুতোয় জীবনের গল্প।
একসময় টাঙ্গাইলের প্রায় প্রতিটি ঘর থেকেই ভেসে আসত তাঁতের ছন্দ। এখনো বল্লার অলিগলি দিয়ে হাঁটলে শোনা যায় সেই টুকটুক শব্দ, যা বলে দেয় এখানকার মানুষ আজও জীবন গাঁথে তাঁতের ফ্রেমে।
টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প শুধু শাড়ি, থ্রিপিস বা গামছা বানায় না; এটি বুনে চলে ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বপ্ন আর আত্মপরিচয়ের জাল। সাদামাটা সুতো থেকে তৈরি হয় টাঙ্গাইলের বিখ্যাত জামদানি, তাঁতের শাড়ি, কাঠের তাঁতে বোনা প্রাচীন প্যাটার্ন কিংবা আধুনিক ডিজাইনের মিশ্রণ।
বল্লার তাঁতশিল্পী আব্দুল খালেক মণ্ডল বলেন, আমার দাদার সময় থেকে এই কাজ করে আসছি। এখন কষ্ট আছে, দাম বাড়ছে কাঁচামালের, কিন্তু এটাই আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।
বর্তমানে দুই ধরণের তাঁতের ব্যবহার দেখা যায়—একদিকে ঐতিহ্যবাহী কাঠের হ্যান্ডলুম, অন্যদিকে আধুনিক পাওয়ারলুম। এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধরণের তাঁতপণ্য। কিন্তু এই শিল্পের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দালালদের দৌরাত্ম্য, এবং তরুণ প্রজন্মের আগ্রহহীনতা।
তবুও হাল ছাড়েননি অনেকে। কেউ উদ্যোক্তা হয়েছেন, কেউ আবার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের তাঁতপণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে। পুরোনো ডিজাইনের সঙ্গে মিশছে নতুন রঙ, নতুন রূপ। মেলায় যাচ্ছে, বিদেশেও যাচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁতের ঐতিহ্য।
তাঁতের সঙ্গে বাঁচা এই জীবন শুধুই পেট চালানোর গল্প নয়, বরং এটি একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। প্রয়োজন সম্মিলিত সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, নীতিগত সহযোগিতা আর আগ্রহী হৃদয়ের স্পর্শ।
এই তাঁতশিল্প বাঁচলে বাঁচবে টাঙ্গাইলের আত্মা। আর তাঁতের শব্দে বাজবে জীবনের জয়গান।