মঙ্গলবার - ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২২শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

জগন্নাথপুরে আব্দুস সামাদ আজাদ এর ২০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও স্মরণ

জগন্নাথপুরে আব্দুস সামাদ আজাদ এর ২০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও স্মরণ

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কৃতি পুরুষ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রদূত, প্রাক্তন এমপি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্ষীয়ান নেতা, তুখোড় পার্লামেন্টরিয়ান, জনগণবান্ধব সাংসদ এবং পঞ্চম সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদের ২০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। ভাটি বাংলার গর্ব, আব্দুস সামাদ আজাদের স্মৃতি বাংলাদেশ যত দিন টিকে থাকবে, তত দিনই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একজন রাজনীতিবিদ কেবল নেতৃত্ব দিয়েই নয়, মানবিকতা, নম্রতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে কীভাবে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারেন- তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত তিনি। তাঁর আন্তরিক দৃষ্টি, হৃদয়গ্রাহী সম্বোধন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ছিল অসাধারণ ও স্মরণীয়।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ- সর্বত্র তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি, আর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিসরে তাঁর অবিচল দৃঢ়তা এক অনন্য অধ্যায়। আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২৬ সালের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে গ্রামের বিদ্যালয়ে ও পরে দিরাই উপজেলার জগদল ভাটিরগাঁও বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৪৩ সনে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক এবং ১৯৪৮ সনে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন৷ তিনি এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস বিষয়ে তিনি এমএ পাশ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে সরকার তাঁর এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আব্দুস সামাদ আজাদ ছাত্রজীবনেই নেতৃত্বগুণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৪-৪৮ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন (১৯৫২), এরপর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (১৯৫৩), যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন (১৯৫৪) এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শ্রম ও যুব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসনের সময় একাধিকবার কারাবরণ করেও রাজপথ ছাড়েননি। ১৯৭০ সালে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। একই বছর তিনি বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন, বুদাপেস্ট বিশ্বশান্তি সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্ব বর্ণবৈষম্য প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দুটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্বাধীনতার পর প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৩-২০০১ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, একসময় বিরোধী দলীয় উপনেতা, আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।

আব্দুস সামাদ আজাদ বাংলাদেশের রাজনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কূটনীতিতে এক অবিসংবাদিত নাম। অনেক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সৃষ্টশীলতায়, জটিলতায়, টানাপোড়েনে, ঘটনাপ্রবাহের স্মরণে, বিস্মরণে, উদযাপনে একটি আবশ্যিক নাম আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে জননেত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে পৃথিবীর অনেক তাবড় তাবড় নেতা তাঁর প্রজ্ঞায় বিমোহিত ছিলেন। এঁদের অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ফিরে আসে, আব্দুস সামাদ আজাদই ছিলেন শেখ হাসিনার কেবিনেটের একমাত্র সদস্য যার মন্ত্রীত্বের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। এমনকি শেখ হাসিনাও তখন প্রথম বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হচ্ছিলেন। সেই অনভিজ্ঞ মন্ত্রিসভার মধ্যে তাঁর মতো অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতার উপস্থিতিই ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানিচুক্তির মতো ঐতিহাসিক সফলতাকে সম্ভব করেছিল। অনেকেই বলেন, তিনি আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকলে তিস্তা নদীর চুক্তিটিও সম্পন্ন হতো। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ বরাবরই পশ্চিমবঙ্গ উইন্ডোকে আমল দিত। সেই সুবাদে বর্ষীয়ান নেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর সখ্য দেশের কাজে লেগেছে ব্যাপকভাবে।

জনগণের সাথে, প্রান্তের সাথে তাঁর নিত্য যোগাযোগ ছিল। শিকড়ের সাথে এত দৃঢ় যোগাযোগ ও বন্ধন খুব কম নেতা্রই আছে বা ছিল। শুনেছি, তাঁর এলাকা জগন্নাথপুরের কোনো সমস্যা নিয়ে পিএসের ‘ইউএনও জগন্নাথপুর অন দ্য লাইন’ বার্তা শোনার সাথে সাথে বিদেশী কোনো কূটনীতিবিদের সাথে আলাপ সংক্ষিপ্ত করে ফেলতেন। অথবা ‘ওসি জগন্নাথপুর অন দ্য লাইন’ বার্তা শোনার সাথে সাথে অন্য কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে দিতেন। মাসে এক দুই বার তো বটেই, তিন চার বারও আসতেন এলাকায়। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিকতার কথা শুনেছি তাঁরই আত্মীয় সিলেট ওভারসিজ সেন্টারের নির্বাহী কর্মকর্তা, আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু প্রয়াত শামসুল আলম ভাই ও আমার অতি ঘনিষ্ঠজন ডাক্তার আব্দুন নূরের (প্রাক্তন জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) নিকট থেকে। জননন্দিত এই নেতার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় দুই বার, একবার আমার একখানা বই নিয়ে যাওয়া, আরেক বার খুশকি। এত উচুঁদরের ব্যক্তিত্বের আচরণে মুগ্ধ হতেই হয়। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা।
জাতীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতি, ক্ষেত্র বিশেষে গ্রুপ পলিটিক্সেরও এক গুরু ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন্দ্র সবসময় প্রান্তের কোন্দল বা গ্রুপ পলিটিক্সের পৃষ্ঠপোষকতা করে। সব দলে আজও গ্রুপিং আছে কিন্তু কোনো গ্রুপেরই তাঁর মতো শিরোমণি নেই।

রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে আব্দুস সামাদ আজাদের মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবি। সিলেটসহ জাতীয় পর্যায়ে তাঁর নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র কিংবা কূটনীতিবিষয়ক ইনস্টিটিউট স্থাপন ও নামকরণ হওয়া উচিত, যা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। এমন মূল্যায়নের মাধ্যমে জাতি কৃতজ্ঞতা জানাবে এই কিংবদন্তিতুল্য মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে। আব্দুস সামাদ আজাদের সংগ্রামী জীবন, আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতি ও মানবিক গুণাবলিই তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn