রবিবার - ১৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২০শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

গর্ভেই নিভে যাওয়া প্রদীপ: সিরাজগঞ্জের এক নারী পুলিশের মৃত্যু

গর্ভেই নিভে যাওয়া প্রদীপ: সিরাজগঞ্জের এক নারী পুলিশের মৃত্যু

মো.কামাল উদ্দিন

সিরাজগঞ্জের আকাশটা সেদিন অদ্ভুত রকম ধূসর ছিল। যেন প্রকৃতিও শোকপ্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রাস্তার ধুলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলো মানুষের গলা ফাটানো স্লোগান, উত্তপ্ত চিৎকার, আর এক অজানা আতঙ্কের শব্দ। এই অরাজকতার মাঝেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন নারী পুলিশ সদস্য—সানজিদা, সাত মাসের গর্ভবতী। তার চোখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু দায়িত্ববোধ ছিল আরও গভীর।
তাকে কেউ চিনত না ব্যক্তিগতভাবে, কিন্তু ইউনিফর্মের ভেতরে তিনি যে একজন মা, সেই কথাটি হয়তো কেউ দেখতেও চায়নি। তার সাথে ছিল না কোনো লাঠি, হাতে ছিল না কোনো বন্দুক—শুধু মায়াবী চোখ দুটোতে ছিল জন্ম-প্রতীক্ষিত সন্তানের স্বপ্ন।
কিন্তু সেই দিন, সেই রক্তাক্ত দিন, মানুষরূপী কিছু হিংস্র জনতা তার সামনে দাঁড়ায়। কেউ চায়নি জানতেও যে তিনি মা হতে চলেছেন। তারা চায়নি শুনতে তার অনুরোধ—“আমি গর্ভবতী, দয়া করুন…” এই কাতর স্বর তাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি।
কারণ, তাদের হৃদয় আর মানুষ থাকার জায়গা ছিল না।
চোখের পলকে কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ লোহার রড দিয়ে আঘাত করে তার পিঠে, কেউ ইট ছোঁড়ে মাথায়। কেউ আবার বুটজুতা দিয়ে পেটের ওপর আঘাত করে। তারা জানত না—না, তারা জানত—এই পেটের ভেতরে একটি হৃদয় প্রথমবারের মতো ধুকপুক করছিল, একটি অবুঝ হাত গুটিয়ে ছিল মায়ের জঠরে। তারা জানত—তবু তারা থামেনি।
থানার কক্ষে সে যখন পড়ে যায়, কেউ এগিয়ে আসে না। সবাই পাশ কাটিয়ে যায়, কিছু ক্যামেরা তাক করে, আর লাইভ ভিডিও হয় তার মৃত্যুর। যেন মৃত্যু আজ এক বিনোদন। যেন গর্ভে সন্তান নিয়েও কেউ নিরাপদ নয়। কেউ তাকে বলে না, “উঠুন মা, আমরা আছি।”
কেউ না।
সানজিদা নিঃশব্দে রক্তে ভিজে যাচ্ছিলো।
তার ভেতরের শিশুটি তখনও হয়তো একটু একটু করে নড়ে উঠছিল—জানতে চাইছিল, “মা, আমরা বাঁচব তো?”
জবাব ছিল না।
একটি শিশুর পৃথিবীতে আসার প্রথম স্পন্দন থেমে গেল মানুষের পায়ের আঘাতে।
একজন মায়ের জীবনের সব স্বপ্ন থেমে গেল দায়িত্বরত অবস্থায়, কর্তব্য পালনের পথে।
তার মৃত্যুর পর কেউ একটি ফুল রাখেনি তার গায়ে, কেউ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিদায় দেয়নি। কারণ সে ছিল ‘সামান্য’ একজন নারী পুলিশ। সে হয়তো বড় কারও আত্মীয় ছিল না, বড় কোনো নেতার পছন্দের তালিকায় তার নাম ছিল না।
কিন্তু সে তো একজন মা ছিল!
এই পরিচয়ের চেয়ে বড় আর কোনো পরিচয় কি হয়?
এই নির্মমতা, এই হিংস্রতা, এই অবমানবিকতা—এ যেন একাত্তরের বর্বরতাকেও লজ্জা দেয়।
সেই সময়েও পাক বাহিনী গর্ভবতী নারীদের এইভাবে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করেনি।
কিন্তু আজ, স্বাধীন দেশে, সেই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পরে, আমরা এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলেছি—যেখানে একজন নারী, যিনি পুলিশ, যিনি মা, যিনি নিজের কর্তব্যে নিয়োজিত—তিনিও রেহাই পান না বর্বরতার হাত থেকে।
আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। আমি কারও বিরুদ্ধে উগ্রতা ছড়াচ্ছি না।
আমি শুধু প্রশ্ন রাখছি—এই হত্যাকারীরা কি মানুষ?
তারা কি কোনও মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিল?
তারা কি জানে গর্ভে থাকা সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা কতটা পবিত্র?
যদি জানত, তাহলে কি তারা এতটা নৃশংস হতে পারত?
আজ তাদের কোনো বিচার হয়তো হবে না।
তাদের ছবি হয়তো পোস্টারেও উঠবে না।
কিন্তু ইতিহাস তাদের মুখ চিরকাল মনে রাখবে—এই বলে, “তারা মানুষরূপী পশু, যারা এক গর্ভবতী মাকে তাঁর সন্তানসহ হত্যা করেছিল—শুধু ঘৃণা আর বিদ্বেষের বশে।”
আর আমরা?
আমরা কি এই মৃত্যু দেখে চুপ করে থাকব?
নাকি অন্তত হৃদয়ে একটু কাঁপন জাগবে—এই ভেবে যে, একজন মা, গর্ভে সন্তান নিয়ে, রাস্তায় নির্মমভাবে মারা গেছেন, আর আমরা কিছুই করিনি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn