মঙ্গলবার - ১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ১৫ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

কাঁদো চট্টগ্রামবাসী কাঁদো

কাঁদো চট্টগ্রামবাসী কাঁদো

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

 

যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা-ই সত্যে পরিণত হল। অঘটন ঘটে গেছে। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু প্রফেসর ড. অনুপম সেন ইস্তফা দিয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ইত্যাদি অভিযোগ তুলে গত কয়েকদিন ধরে চাপ সৃষ্টি করে চলেছিল, তাতে তাঁর সুউচ্চ মর্যাদাকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন যে কোন মানুষই ড. সেন যা করেছেন তাই করতেন। তিনি তো সাধারণ মানুষ নন, সাধারণের মধ্যে অবস্থান করেও অসাধারণ, অনন্য। একালে তো মহামানব, মহাপুরুষ জন্মায় না, পরিবেশ তার অনুকূল নয়। সেকালে পীর আউলিয়া, সাধু-সন্ন্যাসীরা নির্জন গিরি গুহায় বা শ্বাপদসংকুল অঘোর জঙ্গলে নিরিবিলিতে আত্ম নিমগ্ন হয়ে ঈশ্বর সাধনা করতেন, একালে তা সম্ভব নয়। কারণ যন্ত্র সভ্যতা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষ বসতি ও জীবিকার সন্ধানে বন জঙ্গল কিছুই আস্ত রাখছে না। যদি একালে মহামানব বা মহাপুরুষের আবির্ভাব সম্ভব হতো, তাহলে আমি বলতাম ড. অনুপম সেন মহাপুরুষ বা মহামানবের মানবপ্রতিমা।
ড. সেন পদত্যাগ করেছেন, এবার নিশ্চয়ই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাড় জুড়াবে। তাদের তো সাধ মিটলো, কিন্তু তাতে চট্টগ্রামের বাতিঘরটা তো নিভে গেল। যে বাতিঘর গত অর্ধশতাধিক বছর ধরে চট্টগ্রামে জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি ও মনীষার উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে চট্টগ্রামের সমাজকে আলোকিত করেছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন তিনি পদত্যাগ করলেন, তিনি তো কোন অন্যায় করেননি? আর ওরা চাইবে বলে সবাইকে এমনকি গোটা দেশকে ওদের কথায় উঠতে বসতে হবে তাতো কোন কথা হতে পারেনা। তারা তো নিজেরাই বলছে যে, গণতন্ত্রের জন্য তারা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তাহলে তাদের পছন্দ না হলে সবাইকে গিলোটিনাইজড করতে হবে এটা তো গণতন্ত্রের কথা হতে পারে না। এও এক ধরনের ফ্যাসিবাদ।
আমার প্রশ্নের উত্তরে ড. সেন আমাকে বললেন, আমি পদত্যাগ না করলে রক্তপাত হতে পারতো। ছাত্ররা আমার ছেলের মতো, আমার জন্য আমার ছেলেরা রক্তারক্তি করবে, এটা আমি চাইতে পারি না। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পদত্যাগ করেছি। এই হচ্ছেন ড. অনুপম সেন। যে ছাত্ররা তার পদত্যাগ চেয়েছিল, তাদেরকেও তিনি ভালোবাসেন, আপন সন্তানের মতো স্নেহ করেন। এমন মহৎ হৃদয় এবং উচ্চ মানসিকতা সব মানুষের থাকে না, ড. সেনদের মতো মুষ্টিমেয় কজন মানুষের মধ্যেই এই মহত্তম মানবিক গুণাবলী খুঁজে পাওয়া যায়। ড. সেন পদত্যাগ করেও তাঁর পদত্যাগ যারা চেয়েছিল তাদেরকে হারিয়ে দিয়েছেন। তারা হয়তো দেশের সবখানে জয়লাভ করেছে, কিন্তু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জিত হয়নি। প্রথমত: ড. সেন পদত্যাগ করে তাদের মুখের উপর একটি মৃদু চপোটাঘাত করেছেন, দ্বিতীয়ত: প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র ড. সেনের সমর্থক ছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকুক এটা সবাই মনে প্রাণে চাইতো। ড. সেন পদত্যাগ না করলে এ ছাত্ররা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের প্রতিহত করত এবং তাতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতো। এই সংঘাত ড. অনুপম সেন চাননি।
ড. সেন এখন হয়তো চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন। চট্টগ্রামে তাঁর কেউ নেই। তাঁর একমাত্র মেয়ে ঢাকায় অধ্যাপক স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন। তিনি হয়তো সেখানে চলে যাবেন, হয়তো বা কলকাতায় যাবেন। তাদের প্রায় সব আত্মীয়স্বজন সেখানেই আছেন। তাহলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে চট্টগ্রামেরই মস্ত ক্ষতি হয়ে গেল।
জ্ঞান-মনীষা ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে ড. সেন এত উঁচুতে নিয়ে গেছেন যে, তাঁর সমমানের আর কোন পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবী চট্টগ্রামে নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটে চট্টগ্রাম কার দ্বারস্থ হবে? ড. সেন শুধু সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন না। সাহিত্য, দর্শন, কলা ও মানব বিদ্যার সমস্ত শাখাতেই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ক্লাস রুমের বাইরে তাঁর বাসভবনও ছিল একটি এক্সটেন্ডেড ক্লাস। যে কোন বিষয়ের ছাত্র তাঁর জ্ঞান পিপাসা চরিতার্থ করার জন্য ড. সেনের বাসায় অবাধে যাতায়াত করতে পারত। তাঁর বাসার দরজা সবসময় উন্মুক্ত থাকত সব বিদ্যার্থীর জন্য। তিনি আমাদের সক্রেটিস বা প্লেটো ছিলেন। তিনি যদি চট্টগ্রাম থেকে চলে যান তাহলে এখানে মননচর্চায় শূন্যতার সৃষ্টি হবে। যে শূন্যতা কখন পূরণ হবে এখনই তা বলা সম্ভব নয়।

বি: দ্র: লেখা টা বিশিষ্ট সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ভাই এর ফেইসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn