
আশালতা বৈদ্য
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিনি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার, যিনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। স্বাধীনতার মাসে আসুন মহিয়সী সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের গল্প শুনি।
“১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকারেরা তাদের বাড়িতে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে চিঠি দিল, ‘আপনার দুটো মেয়ে আছে, ওদেরকে পাকবাহিনীর কাছে তুলে দিতে হবে, অন্যথায় পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে’। দুই মেয়ে আশালতা ও তাঁর বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি পেয়ে হরিপদ বাবু ও স্ত্রী সরলাময়ী ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। দিনও ঠিক হলো। মঙ্গলবার চলে যাবেন তার ঠিক এক দিন আগে সোমবার রাতে এই ঘটনা জেনে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন এলেন হরিপদ বৈদ্যের বাড়িতে। হরিপদ বৈদ্যকে বললেন ‘মাস্টার বাবু ছেলে হোক বা মেয়ে হোক একজনকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাকে দিতে হবে’। পিছনে থেকে আশালতা বলে উঠলো, বাবা আমি যাবো যুদ্ধে। হেমায়েত উদ্দিন বললেন এইত পেয়ে গেছি। মেয়ের আগ্রহ দেখে বাবাও আর আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন, ‘ও নিজে থেকে যু’দ্ধে যেতে চাইলে আমি অবশ্যই বাধা দেব না, দেশের জন্য ওকে আমি উৎসর্গ করলাম।’
আশালতাকে নিজের মাতৃভূমিতে থেকে দেশমাতৃকা তথা মা বোনের সম্মান রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন হেমায়েত উদ্দিন। আশালতা উদ্বুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। হেমায়েত উদ্দিন খুশি হলেন। আশালতাকে কাছে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন এবং বললেন, ‘তুই কালকে সকাল বেলা ৩০-৪০/৪০-৫০ জন মেয়ে গুছিয়ে লেবুবাড়ি স্কুলে আসবি, পারবি?’ আশালতা জানালেন পারবো।
হেমায়েত উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বলেছেন একথা শুনে অন্যরা সবাই সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাজি হলো। ছোট দুই বোন এবং ভাই হরগোবিন্দসহ মোট ৪৫ জন সহপাঠী ও প্রতিবেশী মেয়ে নিয়ে তিনি লাটেঙ্গা লেবুবাড়ী সরকারি প্রাথমিক স্কুলে উপস্থিত হলেন।
আশালতা বৈদ্যের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। ১৬ বছর বয়সী আশালতা ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত মহিলা বাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য।
নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গে’রিলা দলকে। তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুর বাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের উপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণে সেখানে ফাস্ট হলেন।
এরপর অংশগ্রহণ করলেন বেশ কয়েকটা যুদ্ধে যার ভেতর কলাবাড়ি যুদ্ধ, হরিনাহাটি যুদ্ধ, রামশীল পয়সার হাট যুদ্ধ অন্যতম।
আশালতার সাহসিকতায় ক্যাম্পের ২৪ জন নারীকে নিয়ে হেমায়েত উদ্দিনের আদেশে আলাদা একটা নারী কমান্ডো তৈরি করা হয়েছিল, যার নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। যাঁদের কাজ ছিল শত্রুর অবস্থান রেকি করা, ছদ্মবেশে গেরিলা আক্রমণ করা এবং সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করা। আশালতা সহ তার কমান্ডের সকলেই সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করার জন্য ছিলেন সদা প্রস্তুত।
রামশীল নদী পাড়ে একদিন লঞ্চে করে রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সাথে নিয়ে আসে। সেখানে আশালতা এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হয়েছিল সেদিন।
গোপালগঞ্জে ছোটোখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজ হাতে। এই অপ্রতিরোধ্য নারী যোদ্ধা সেদিন যুদ্ধকেই ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর তাদের টিম শরণার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন।
স্বাধীনদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। ১৯৮০-এর দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী সংস্থা’। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। যদিও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পাননি। তেমন কেউ চেনেও না তাঁকে।“
কার্টেসি: গিরিধর দে