রবিবার - ১৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - ২০শে জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

আম ক্যালেন্ডার নিয়ে বিড়ম্বনায় সাতক্ষীরার বাগান মালিকরা

আম ক্যালেন্ডার নিয়ে বিড়ম্বনায় সাতক্ষীরার বাগান মালিকরা

সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আমের কদর আছে দেশ বিদেশে। আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে এখানকার আম দেশের অন্য এলাকার তুলনায় অগ্রিম পরিপক্ব হয়। আগে বাজারে ওঠার কারণে বেশি দামে বিক্রিও হয় এই আম।

সাতক্ষীরা জেলায় ৪ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫ হাজার আম বাগান রয়েছে। চলতি বছর এখান থেকে এবার ৬২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা কৃষি বিভাগ। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
গত কয়েক বছর আমের গুণগত মান ঠিক রাখতে জেলা প্রশাসন থেকে আম সংগ্রহের নির্ধারিত সময় বেধে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য আমের জাতভেদে গাছ থেকে সংগ্রহের জন্য তৈরি করা হয় আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ ক্যালেন্ডার। তবে এই আম ক্যালেন্ডার নিয়ে আম চাষিদের রয়েছে নানা অভিযোগ
আমের রাজ্যে চাষির স্বপ্ন
বিশ্বের সবচেয়ে দামি ‘সূর্যডিম’ আম ঝুলছে যশোরের খামারে
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা এলাকার আমচাষি মো. আল আমিন বলেন, আমাদের গ্রাম সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে। এটি লবণাক্ত এলাকা হওয়ায় গাছে অগ্রিম মুকুল আসে। অতিরিক্ত গরমের কারণে জেলার অন্য এলাকা থেকে এখানে গোবিন্দভোগ জাতের আম ১৫-২০দিন আগে পরিপক্ব হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে সময় নির্ধারণ করা হয় জেলা সদরের আম গাছ দেখে। এতে আমাদের গাছের আম গাছেই নষ্ট হয়। তবে গতবার আমি একটু আগে আম বিক্রির চেষ্টা করেছিলাম। তখন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা এসে আমাকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। আমার কাছ থেকে ৮ ক্যারেট কাঁচা আমও নিয়ে যায়।

সাতক্ষীরা সদরের কুকরালি এলাকার আমচাষি রাহাত বলেন, বাগানে প্রচুর আম হয়েছে। ইতোমধ্যে গোবিন্দভোগ জাতের আম পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু অনুমতি না থাকায় সেই আম বাজারে বিক্রি করতে পারছি না।
তিনি বলেন, চাষিদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর পরামর্শে কৃষি বিভাগ ও জেলা প্রশাসন থেকে আম পাড়ার তারিখ নির্ধারণ হয়। এতে আমরা সময়মতো আমের বাজার ধরতে পারি না। তার ওপর রয়েছে বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা। ফলে প্রতি বছরই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচেছ

সদর উপজেলার লাবসা এলাকার আম বাগান মালিক বলেন, সময়মতো আম বিক্রি করতে না পারায় অনেক বাগান মালিক লোকসানের মুখে পড়ছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় অনেক আম বাগান নষ্ট হয়েছে। প্রতি বছর মে মাসে দুর্যোগ আসছে। এতে আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ি। তাছাড়া আম বাজারজাত করতে তারিখ নির্ধারণ করায় সবাই একসঙ্গে বাজারে আম নিয়ে গেলে আমের দাম কম হয়ে যায়। হাজার হাজার আমচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেকে বাগানের গাছ কেটে কমিয়ে ফেলছেন। সেখানে অন্য ফসল চাষ করছেন।

সদর উপজেলার দহকুলা এলাকার আম ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, আমে কেউ ফরমালিন মেশায় না, অনেকে আম বেশি বড় করার জন্য চাষের সময় হরমোন প্রয়োগ করে। যে কারণে তাদের আম সময়ের আগে বেশি বড় দেখায়। এসব আম অসাধু ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে ইথোফেন ও কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করে। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিক। কিন্তু তাদের অপরাধের দায় ভোগ করতে হয় সব আম চাষিকে। সব আমচাষি ও ব্যবসায়ী অসাধু নয়। উপকূলীয় জেলার একেক জায়গার আবহাওয়া একেক রকম। এজন্য অনেক এলাকার গাছে মে মাসের শুরুতে আম পাকা শুরু হয়। আর কিছু জাতের আম মে মাসের মাঝামাঝি বা শেষে পাকতে শুরু করে। এ বিষয়ে উপজেলা ভিত্তিক আম ক্যালেন্ডার হলে ভালো হয়।

সাতক্ষীরা বড় বাজার কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রওশন আলী জাগো নিউজকে বলেন, সাতক্ষীরার আম আগেভাগেই বাজারে আসে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা আম কিনতে ইতোমধ্যে সাতক্ষীরায় আসতে শুরু করেছে। তবে অপরিপক্ব আম বাজারে না আসায় অনেকে বাগান থেকে চাষিদের বেশি দাম দিয়ে অপরিপক্ব আম কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা এসব অপরিপক্ব আম কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বেশি দামে বিক্রি করছে। প্রশাসনের অভিযানে অনেক আম আটক করা হলেও গোপনে বিপুল পরিমাণ অপরিপক্ব আম ঢাকায় চলে যায়। অথচ বড় বাজারের আড়ত মালিকরা প্রচুর টাকা দাদন দিয়ে বাগান কিনেছেন। অনুমতি না থাকায় তারা বাজারে সব জাতের আম বিক্রি করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা বড় বাজারে গোলাপখাস, বোম্বাইসহ দেশি জাতের টক আম উঠতে শুরু করেছে। এ বছর সাতক্ষীরায় আমের ফলনও ভালো। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আম চাষিদের লোকসান এড়াতে আম সংগ্রহের দিন এগিয়ে নিয়ে আনার দাবি তার।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, অপরিপক্ব আম বাজারজাত রোধে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে অপরিপক্ব আম আটক করে বিনষ্ট করা হচ্ছে।

তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া আম আটক ও বিনষ্ট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, এটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা আম যাচাই বাছাই করে প্রত্যয়নপত্র দিলে সেটি বাজারজাত করা যাবে। কিছু এলাকায় আগাম জাতের আম পরিপক্ব হলেও অধিকাংশ এলাকায় সব জাতের আম পরিপক্ব হয়নি। নির্ধারিত সময়ে আম সংগ্রহ করা হলে দেশে বিদেশে সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হবে জানান তিনি।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিষ্ণুপদ পাল সাংবাদিকদের বলেন, জেলার আমের সুনাম রক্ষায় আম চাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে আম ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসন। এ বছর এখনও তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। নির্ধারিত তারিখের আগে কেউ আম বাজারজাত করার চেষ্টা করলে সেটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আটক ও বিনষ্ট করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৯ হাজার কেজি কার্বাইড মিশ্রিত আম বিনষ্ট করা হয়েছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn