
আমার ছোটবেলার স্মৃতি
—————————–
চৈত্র সংক্রান্তি দিনে পটিয়ার চক্রশালায় প্রতিবছর মেলা বসে । আমার মামার বাড়ি বাঁকখালী তাই আমরা মামাতো ভাই বোন মিলে মেলায় যেতাম। প্রায় কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে এই মেলায় যেতে হতো । যারা এই মেলায় যেতো তারা মেলার মন্দিরে পূজো দেওয়ার জন্য এবং ওখানে ভান্তেদের খাওয়ানো ও নিজেদের খাওয়ার জন্য ভাত তরকারি নিয়ে যেত । মেলার পাশে ছিল একটি বড় পুকুর । সে পুকুর পাড়ে বসে দুরদুরান্ত থেকে আসা সবাই দুপুরের খাবার খেত । সাদা শুকনো ভাতের সাথে বেগুন ভাজি, শুঁটকি ভর্তা, সবজি এগুলো নিয়ে যেত আর মনের আনন্দে সবাই মিলে খেত । ছোটবেলায় প্রায় যাওয়া হতো মামা মামী, মাসি, মামাতো ভাইবোন সবাই মিলে । একবার আমি এই মেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন বোধ হয় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি । আমরা বাবার চাকরি সুবাদে নোয়াখালী থাকা হতো তাই গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি আসা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা । আমি সবাইকে ছেড়ে চড়কি দেখছিলাম এক মনে । নোয়াখালীতে এসব হয় না তাই ওখানে বসে চড়কি দেখছি । সবাই আমাকে খুঁজছে। হঠাৎ আমার ভীষণ ক্ষিদে লেগেছে কিন্তু আমি তো সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি। একপাশে বসে কান্না করছি তখন একজন ভদ্রলোক বলল এটা ডাঃ প্রিয় দর্শন চৌধুরীর ভাগিনী না ? আমি তখন সাহস পেলাম বললাম হ্যাঁ। লোকটাকে বলেছি কিন্তু আমি হারিয়ে গেছি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না ? তখন লোকটা আমাকে আমার মামার বাড়ি নিয়ে আসলো ।
ঠেগরপুনি কিছু কথা –
” পটিয়ায় এক তীর্থ ঠেগরপুনি নাম
ঐ তীর্থে বাতি দিলে পুরে নমস্কাম ”
পটিয়া থানা থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ – পশ্চিমে ঠেগরপুনি গ্রাম। এই গ্রামে আছে ‘ বুড়া গোঁয়াই’র( বুড়া গোঁসাই) মন্দির। মন্দিরটি বেশ পুরোনো। ছোট মন্দিরটির ভিতরে আছে অতি প্রাচীন বুড়া গোঁসাইর মূর্তি । পাথরের মূর্তিটির মস্তকটি বসানো আছে শরীরের নিম্নাঙ্গের ওপর, যদিও কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকায় পূজারিরা তা ঠিক মতো বুঝতে পারেন না।
গ্রামের বাইরে একটি ভিটার উঁচু জায়গায় ছিল একটি ছোট প্রস্তর খন্ড । মাটির ওপর যার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দৃশ্যমান ছিল । সেটার ওপর গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলা করে । পাথরটি ওপর একটি ছোট গর্ত কে উনুন বানিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা রান্নাবাটি খেলতো । রুপকথার সেই গল্পের কথাগুলো আমার মামার কাছে শুনা । কতোটুকু সত্য আমি তা জানি না । আমার মামার বাড়ি বাঁকখালী গ্রামে , শুনেছি একজন মহিলা এক রাতে স্বপ্ন দেখেন – আসলে ঐ পাথরটি একটি বুদ্ধ মূর্তি, তাঁকে মূর্তিটি উদ্ধার করে ওপরে তুলে দেবার আহবান জানালো । পরেরদিন সকালে তিনি গ্রামের লোকজনকে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালো । তখন গ্রামের কয়েকজন ঐ মহিলাসহ ঠেগরপুনিতে আসেন । তাঁরা ঠেগরপুনির কয়েকজনকে সাথে নিয়ে মাটি সরিয়ে দেখতে পান , সত্যি পাথরটি একটি খোদাই করা বুদ্ধের মস্তক। এরপর তাঁরা মূর্তির বাকি অংশ খুঁজতে থাকেন । তাঁরা খালের পাড়ে খুঁজে পান মূর্তির নিচের অংশ। ( কোমড় থেকে পা পদ্মাসন অংশ ) । সম্ভবত মূর্তিটি ছিল ধ্যানরত বুদ্ধের পদ্মাসন উপবিষ্ট মূর্তি । অনেকে অনুসন্ধানে পরও দেহের মধ্য অংশটি ( ঘাড় থেকে কোমড় পর্যন্ত অংশ ) পাওয়া যায় এরপর আর পাওয়া যায় নি । পরে যখন মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয় । তখন পদ্মাসন অংশটির ওপর মস্তকটি বসিয়ে দেওয়া হয়।
মন্দির নির্মাণ করে বুদ্ধমূর্তি স্থাপনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক প্রাচীন মূর্তি বলে এটি সকলের কাছে ‘ বুড়া গোঁয়াই’ বা বুড়া গোঁসাই নামে পরিচিত। এটি হয়ে উঠে চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান।
প্রতি বছর। মাঘী পূর্ণিমার দিনে মন্দিরের সামনে বিরাট মেলা ( বুড়া গোঁসাইয়ের ) বসে । বহু দুরদুরান্ত থেকে শত শত বৌদ্ধরা মেলায় যোগদান করে। তারা মন্দিরে বাতি জ্বালায় ,পূজো দেয় , মানত করে। মেলার পাশে পুকুরের পাড়ে তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামের জায়গা আছে। এ এলাকায় শীতকালের বড় আকর্ষণ ঠেগরপুনির এই ‘ বুড়া গোঁয়াই ‘ বা গোঁসাইয়ের মেলা । এই মেলা থেকে মানুষ সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেয় যেমন : মাটির হাড়ি পাতিল, বাঁশ বেতের ঝুড়ি, দাও, কোদাল ,খুন্তি, বিছানার পাটি, মাদুর , কাঠের দ্রব্যাদি , এসব মানুষ কিনে নিয়ে যায়। এই মেলায় বহু পুরোনো আত্নীয়দের সাথে দেখা হয় । এই মেলায় বহু দুর থেকে ভেসে আসে বাঁশি ও বাজনার শব্দ । মন্দিরে ঢুকে ‘বুড়া গোঁসাইয়ের সামনে মোমবাতি জ্বালানো হয় । চারদিকে শুধু ধূপধূনা ও পোড়া মোমবাতির ধুঁয়া ও গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। মেলায় আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল নাগরদোলা ও ঘোড়ার চড়কিতে চড়া , কাঠের বাক্সের বায়স্কোপ দেখা, পুতুল কেনা, এবং বুট বাদাম ও চট্রামোট্রা খাওয়া। ছোটবেলায় মামার বাড়ি গিয়ে ছোট ছোট ভাই বোনদের সাথে সারাদিন মেলায় ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আনন্দকে কখনো ভূলার মতো না । আমার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট লাগে । এখন বাচ্চারা এগুলো পছন্দ করেনা। আমার আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই শৈশবে । যদি পারতাম তাহলে আমি প্রথমে শৈশবে ফিরে যেতাম ।
অনামিকা বড়ুয়া।
বৈদ্যপাড়া বোয়ালখালী চট্টগ্রাম।