
আদালতের বারান্দায় ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের উপর হামলার চেষ্টা
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার রাধাবল্লভপুর মদনপাড়া ভূমিহীন পল্লীতে হামলা, মারপিট, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত দ্রুত বিচার আইন, পেনাল কোর্ড ও নারী নির্যাতনের মামলায় আট আসামীর জামিন আবেদন না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার আসামীরা হাইকোর্টের নির্দেশে সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক মোঃ নজরুল ইসলাম তা না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
জামিন না’মঞ্জুর হওয়া আসামীরা হলেন, আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি ইউনিয়নের ব্রাহ্মণতেঁতুলিয়া গ্রামের সামছুর মোড়লের ছেলে আবু সাঈদ মোড়ল, একই গ্রামের মৃত আলফাজউদ্দিন মোড়লের ছেলে রইচউদ্দিন মোড়ল, মাহামুদুর রহমান সরদারের ছেলে নজরুল সরদার, আলফাজউদ্দিন মোড়লের ছেলে জহিরউদ্দিন মোড়ল ও তার ভাই মুজিবর মোড়ল, হান্নান মোড়লের ছেলে আরাফাত মোড়ল, মকছুদ মোড়লের ছেলে অহিদুল মোড়ল ও রুহুল আমিন মোড়লের ছেলে আল মামুন মোড়ল।
এদিকে আসামীদের পক্ষে গত ৪ মে এর ন্যায় মঙ্গলবারও জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানীর সময় হাজির ছিলেন আশাশুনির বহুল আলোচিত সোহাগ। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে আদালত থেকে পুলিশ আসামীদের গারদখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত পিপি অফিসের সামনে ছবি তুলতে গেলে দুই সাংবাদিকের উপর চড়াও হয় আসামীদের স্ত্রীসহ স্বজনরা। গালিগালাজের একপর্যায়ে ওই সাংবাদিকদের না পেয়ে নকলখানার সামনে অপেক্ষমান বিচারপ্রার্থী তালা উপজেলার সুজনশাহা গ্রামের আমিরুল ইসলামকে সাংবাদিক ভেবে মারপিট করে তারা। তারা ওই দুই সাংবাদিকদের খোঁজে আদালতের বিভিন্ন স্থানে হানা দেয়। কয়েকজন বিচারপ্রার্থীর সহেেযাগিতায় আহত আমিরুল ইসলামকে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ভূমিহীন মিজানুর রহমানকে আদালতের মধ্যে মারপিট করে নতুন নতুন মামলায় ঢোকানো সংক্রান্ত সোহাগের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপা হওয়ায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আসামীদের স্বজনদের ওই নেতা উস্কে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে আদালতের বারান্দায় সাংবাদিকদের উপর আসামীদের স্বজনদের চড়াও হওয়ার বিষয়টি পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সিসি টিভি ও মোবাইলে তোলা ভিডিও ফুটেজ দেখে হামলাকারিদের সনাক্ত করা হবে বলে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, মরিচ্চাপ নদীর আশাশুনির রাধাবল্লভপুর মদনপাড়ার চরভরাটি জমিতে দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ৩৫টি ভূমিহীন পরিবার শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। কিছু জমি তারা ডিসিআর পেয়েছেন। আবার ১৫টি পরিবার মৎস্যজীবি সমিতি গঠণ করে চরের ৩০ বিঘা জমি পেতে পানি উন্নয়ন বোর্ডে ডিসিআরের আবেদন করেন। সম্প্রতি মরিচ্চাপ নদী খননের ফলে তাদের অনেক জমি বেড়িবাঁধে চলে যায়।
এরপরও ইউনিয়ন বিএনপি’র একাংশের আহবায়ক ব্রাহ্মণ তেঁতুলিয়া গ্রামের জহিরউদ্দিন মোড়ল, তার চাচাত ভাই কাদাকাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ, রইচউদ্দিন মোড়ল, নজরুল সরদার, বড়খোকনসহ একটি চক্র ভূমিহীনদের ওই জমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে আসছিলো। বাধ্য হয়ে আজিজুল গাজী বাদি হয়ে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদসলতে রইচউদ্দিনসহ নয় জনের নামে ১৪৫ ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলার নোটিশ পেয়ে আবু সাঈদ ও জহির উদনের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গত ২৭ ফেব্রুয়ারী সকালে মদনপাড়ার ভূমিহীন পল্লীতে হামলা, ভাংচুর ও ১০ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটপাট শেষে পেট্রোল দিয়ে ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আহত ২০ জন ভূমিহীনদের আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় জাকির হোসেন বাদি হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি জামিন না’মঞ্জুর হওয়া ১৬জনসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৮০ জনের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা বিঘœকারি অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন ২০০২ সংশোধনী ২০০৯ এর ৪/৫ ধারাসহ পেনাল কোর্ডের ১৫টি ধারা ও নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে আশাশুনি থানায় মামলা(জিআর-৩১/২৫) দায়ের করেন। আসামীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তেঁতুলিয়া ব্রীজের পাশে মানববন্ধন করেন নির্যাতিত ভূমিহীনরা।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু বলেন, এজাহারনামীয় ৩২ জনের মধ্যে জামিন না’মঞ্জুর হওয়া আটজন আসামী গত ৮ এপ্রিল মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি বিচারপতি মোঃ মাহাবুব উল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ হামিদুর রহমানের বেঞ্চ থেকে চার সপ্তাহের অস্তবর্তীকালিন জামিন লাভ করেন। ক্রিমিনাল মিস কেস নং ২৪৯৫২/২৫। আদালত তাদেরকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করতে বলেন। তারই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার আটজন আসামী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। বিচারক মোঃ নজরুল ইসলাম তাদের জামিন আবেদন না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু আরো জানান, বাকী ২৪ জনের মধ্যে ১৬ জন মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হলে বিচারক মোঃ নজরুল ইসলাম গত ২৩ এপ্রিল তাদের জামিন আবেদন না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ নেন। একইভাবে সাতজন আসামী উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ৪ মে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামির আবেদন জানালে আদালত না না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ মামলায় ২৩ জন আসামী জেল হাজতে রয়েছেন। আসামী জাহাঙ্গীর আলম পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরায় কর্মরত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, জামিন না’মঞ্জুর হওয়া আসামীদের আদালত চত্বরে ছবি তুলতে আইনগত কোন বাধা নেই। আর সেই ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের উপর চড়াও হওয়ার বিষয়টি দূঃখজনক। এতে ভূমিহীনদের উপর যে বর্বোরোচিত হামলা হয়েছে তা প্রকাশ্যে এলো।
আসামীপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাড.বাসারতুল্লাহ আওরঙ্গী বাবলা ও অ্যাড. স.ম মমতাজুর রহমান মামুন।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. সিহাব মাসুদ সাচ্চু ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু।
অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু আটজন আসামীর জামিন না’মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।