শনিবার - ২২শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ - ৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ২২শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

অস্থায়ী দুনিয়ায় ক্ষণস্থায়ী জীবন,সময়ের বেলাভূমিতে পদচিহ্ন রেখে যান

অস্থায়ী দুনিয়ায় ক্ষণস্থায়ী জীবন,সময়ের বেলাভূমিতে পদচিহ্ন রেখে যান

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
———————–
মহানবী হয়রত মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করে গেছেন,মানবতার সেবায় যিনি নিজের জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনি মহামানব। আজ মহামানব পাওয়াটা সহজ নয়,সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষ পাওয়া কঠিন, যে মানুষ সমাজের উপকার নয়, অপকার করবেনা, যে ন্যায় কাজ নয়, শুধু অন্যায়, কাজ করবে না, যে ভালোবাসা নয়, শুধু ঘৃণা করবে না।সে মানুষ এবং সে মানুষের আদর্শ আজ প্রজন্মের নিকট কোথায়!যাঁরা আমাদের সমাজকে ঋণী করে গেছেন, যে ঋণ শোধিবেনা কোনদিন। যে ঋণ আমাদের নত করেনি, বড় করেছে, দরিদ্র করেনি ধনী করেছে,তাঁরা পুরো জাতির জন্য নমস্য। পালি ভাষায় একটি কথা আছে, ‘পুজাচ্ছা পুজানিয়ানং এতাং মুঙ্গল মুত্তমং’ অর্থাৎ পূজনীয় ব্যক্তিকে পূজা করা মঙ্গল ও উত্তম। পূজনীয় মহামনীষীদের জীবন আমাদের বিব্রত করে। এঁদের জীবন আমাদের স্মরণ করে দেয়, আমাদের একটা লড়াই ছিল আমরা লড়ছি না। আমাদের নিরবতা প্রজন্মের নিকট লজ্জিত হওয়ার মত। দুনিয়ার সেরা সেরা ধনকুবের তাঁদের সমস্ত ধনসম্পদ মানবতার জন্য উৎসর্গ করেন। আমাদের দেশের কিছু লোক সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করে ধনী হয়। তারা বুঝে না মৃত্যুর নিকট ধনী গরিব ক্ষমতাধর, ক্ষমতাহীনের কোন পার্থক্য নেই। করোনাকালে বাংলাদেশের এক বড় শিল্পপতির মৃত্যু হয় হাসপাতালে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি চিকিৎসকদের বলেছিনে, ‘সব সম্পদ নিয়ে যান, শুধু আমাকে বাঁচান। শত চেষ্টা করে চিকিৎসকগণ তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে আসেননি তাঁর কোন সন্তান।অথচ তারা তাঁর সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী।দুনিয়াতে যারা ভোগবাদী ধনী তারা নাকি মৃত্যুকালে গরিবের চেয়ে বেশি মনোযন্ত্রণায় মরেন।অঢেল সম্পদ ভোগ না করে ফেলে যাওয়ার কষ্ট গরিবদের নেই,যা ধনীদের রয়েছে।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন, এমন ভাবে দুনিয়াতে বসবাস করো যেন তুমি একজন মুসাফির। অর্থাৎ আমরা দুনিয়াতে পথ অতিক্রমকারী মাত্র। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মুসলমানের জন্য সবচেয়ে দামি জিনিস ঈমান। আমাদের ঈমানকে মজবুত
করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মৃত সে নয়, যে প্রাণে হারিয়েছে, প্রকৃত মৃত সেই যে ঈমান হারিয়েছে। সোজা কথায় আমাদের ভবিষ্যৎ বলতে আছে শুধু কবরস্থান। সেখানে ঈমান নিয়ে যেতে হবে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.)’র নিকট জানতে চাইলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি কবরস্থান দেখিয়ে বললেন, এটি আমার বাড়ি। তিন বার একই প্রশ্ন করলে তিনি কবরস্থানকে দেখিয়ে একই উত্তর দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনার আসল বাড়ি কোথায়? তিনি বললেন, দুনিয়াতে যে আমার বাড়ি আছে সেটি আমার আসল বাড়ি নয়, এটি আমার বাপের বাড়ি, তার আগে ছিল আমার দাদার বাড়ি, তার আগে আমার দাদার বাপের বাড়ি। সেটি আমার বাড়ি নয়। আমার আসল বাড়ি কবরস্থান। হাসন রাজা বলেছেন, ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকমু আর/ আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাক না চুল আমার’।
এই ঘর এই সম্পদ কোন কাজে আসে না। দুনিয়ার সম্পদ দুনিয়ায় ফেলে চলে যেতে হয়। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন শূন্য হাতে মুষ্টিবদ্ধ থাকে। যখন মৃত্যুবরণ করে তখন মানুষের হাতকে কোন ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করা যায় না। কারণ মানুষ দুনিয়াতে এসে অনেক কিছু আকড়ে ধরতে চায়, কিন্তু কোন কিছুই দুনিয়া হতে ফেরার সময় নিয়ে যেতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জন্মেছিস যখন দুই একটি দাগ রেখে যা’।একজন ইংরেজ কবি বলেছেন Foot prints on the sands of time অর্থাৎ সময়ের বেলাভূমিতে পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়, ‘কীর্তিযসা স জীবতি’ অর্থাৎ মানুষের কীর্তিই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্টি হেমিংহোয়ে বলেছেন, ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায়, কিন্তু পরাজিত করা যায় না’। মানুষের কর্ম ও আদর্শের মৃত্যু নেই।
প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মাউতু কাবলা আন তামউতু। হাসিবু কাবলা আন তুহাসাবু আলাই। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে মরে যাও। হিসেব নেওয়ার আগে তোমার হিসেব তুমি করো। মৃত্যুর আগে যারা মরে যায় তাদেরকে কোরআনের ভাষায় বলা যায় ‘বাল আহইয়াউ ইন্দা রাব্বিহিম উরজাকুন’ অর্থাৎ তারা জীবিত, তাদের রিজিক প্রদান করা হয়।
মানুষের মধ্যে তিনটি জিনিস আছে, দেহ, নফস এবং রুহ। দেহ আর নফস মুসাফির নয়। রুহ-ই মুসাফির। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘কুল্লু নফসিন জাইকাতুল মাউত’ প্রত্যেক নফসের মৃত্যু হবে। রুহের মৃত্যু নয়। রুহের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চিয় আল্লাহর নিকট ফিরে যাবো। জীবনের সব স্বাদ বিনাশকারী হলো মৃত্যুর স্বাদ। জীবনের সকল ক্ষুধা, তৃষ্ণা, স্বাদ গ্রহণ শেষে যে স্বাদ মানুষকে গ্রহণ করতে হয় তা হলো মৃত্যুর স্বাদ। কার মৃত্যুর স্বাদ কেমন ছিল তা মৃত ব্যক্তির চেহারা দেখরে বুঝা যায়। নফসের নফসানিয়াতের কারণেই রুহের উপর শান্তি হয়। রুহ আমাদের শরীরে আছে এবং তার ক্রিয়া আমরা বুঝতে পারি। দেহ হতে রুহ চলে গেলে শরীরটা অবশ হয় তাও বুঝা যায়। কিন্তু রুহটি শরীরের কোথায় অবস্থান করে তা আমরা বুঝতে পারি না। অনেক বিজ্ঞানী, বহু ডাক্তার গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি রুহের অবস্থান শরীরের কোথায়। কোন কোন বিজ্ঞানী বলেছেন, রুহ পুরো শরীরে অবস্থান করে। তাদের যুক্তি খণ্ডন করে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, রুহ পুরো শরীরে অবস্থান করলে, যাদের হাত পা কেটে ফেলা হয় তাদের রুহ কী ছোট হয়ে যায়? হাত পা হীন ব্যক্তির রুহ ছোট হয় এটি তারা প্রামাণ দিতে পারেননি। কোন কোন বিজ্ঞানী বলেছেন, রুহ হার্টে অবস্থান করে। তাদের যুক্তি খণ্ডন করে কিছু বিজ্ঞানী বলেন, উন্নত বিশ্বে মানুষের হার্ট পরিবর্তন করে কৃত্রিম নতুন হার্ট সংযোজন করছে তাদের রুহ কী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এসব বিতর্কের সমাধান কোন বিজ্ঞানী দিতে পারেননি। পারবে না। কারণ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘কুলির রুহ মিন আমবি রাব্বি’ রুহ হলো আল্লাহর অর্ডার-নির্দেশ। আল্লাহর আঁকার নেই, তাঁর নির্দেশও আঁকার নেই। তাই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাবে কী কবে। যে কোন মুহুর্তে যে কোন বয়সে আল্লাহর অর্ডার তিনি তাঁর নিকট ফিরিয়ে নিতে পারেন। অল্প বয়সে মৃত্যু হলে মানুষ বলে অকাল মৃত্যু। আসলে অকাল মৃত্যু বলে কিছু নেই, এটি কোরআন বিরোধী কথা। আকস্মিক মৃত্যু বলা যায়। কারণ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য মৃত্যু নির্ধারণ করেছি। (সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ৬০) যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন মৃত্যু সেখানে সঠিক সময়ে হাজির হবেই। মহান আল্লাহর বাণী কোরআনের ঘোষণা হলো,প্রত্যেক জাতির একটা সময় আছে, যখন তাদের সময় আসবে তখন এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারবে না, আবার ত্বরাও করতে পারবে না। (সুরা আল আবাফ: আয়াত: ৩৪)
মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে হবে, আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আমাদের সব সময় মাথায় রাখতে হবে অস্থায়ী দুনিয়ায় আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন। লাইফটা ‘ওয়ান টাইম’ ও ‘ওয়ান ওয়ে’ ব্যবস্থা। মরণ হলো আখিরাতে প্রবেশদ্বার। হাদিসে পাকের বর্ণনা অনুয়ায়ী এই মৃত্যু কারো জন্য জান্নাতের বাগান আর কারো জন্য জাহান্নামের গর্ত। মানুষ যদি মৃত ব্যক্তির আর্তনাদ এবং কষ্ট শুনতে পেত তাহলে মানুষ মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না না করে নিজের জন্য কান্না করতো।তাই মৃত ব্যক্তির মুক্তির জন্য দোয়া করতে হয়। জানাজায় নামাজটা হলো উৎকৃষ্ট দোয়া। এই নামাজের মাধ্যমে তিনটি মহান কাজ সম্পাদিত হয়। (১) মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন। (২) বিদায় সম্ভাষণ জানানো হয়। (৩) নাজাতের জন্য দোয়া করা হয়। এ ধরনের সম্মানের বিধান কোন ধর্মমতের মধ্যে আছে কিনা আমার জানা নেই।
জানাজার নামাজের দোয়াটি অসাধারণ একটি দোয়া।যে দোয়ায় সমস্ত জীবিত ও মৃত সবার জন্য দোয়া রয়েছে। এমন কি এই দোয়ায় অমুসলিমদের ঈমান আনার দোয়া রয়েছে। এই দোয়া অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষও জানে না। অথচ তাদের শিক্ষার কত অহংকার দেখতে পাই। ডিগ্রী পাস করলাম, মাস্টার্স পাস করলাম, পিএইচ ডি করলাম, কিন্তু জানাজার অসাধারণ দোয়াটা শিখতে পারলাম না, ভালো করে নামাজটা শিখলাম না, এই শিক্ষা আর শিক্ষিত দিয়ে আমাদের কী হবে।

লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn